বিয়ের পর অনেকের ওজন বাড়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়ে যায়, যা বিভিন্ন শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারে। যদিও বিয়ের পর কেন মোটা হয় এই পরিবর্তনই কেন সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, তবে বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে এটি একটি সাধারণ সমস্যা। বিয়ের পর ওজন বৃদ্ধির কারণগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।
দীর্ঘ সময় বিয়ের আয়োজন
আমাদের দেশে এখন অনেক বিয়ের আয়োজনই হয় লম্বা সময় ধরে। এনগেজমেন্ট, প্রিওয়েডিং ফটোশুট, গায়েহলুদ, মেহেদি সন্ধ্যাসহ নানা আয়োজনে রাখা হয় উচ্চ ক্যালরির খাবার-দাবারের ব্যবস্থা। বিয়ে বা বউভাতের জম্পেশ খানাপিনা তো আছেই। তবে এটাও ঠিক, নিজের বিয়ের খাবার হয়তো কবজি ডুবিয়ে খাওয়ার সুযোগ হয় না! তবে বিয়ের জন্য ,নিজের ও পরিবারের সবার কেনাকাটা থেকে শুরু করে আয়োজনের নানা ঝক্কি-ঝামেলাতে স্বাস্থ্যকর খাওয়াদাওয়ার অভ্যাস ধরে রাখাটা অনেক সময় মুশকিল হয়ে পড়ে। বাজারে কেনাকাটা করতে গিয়ে বেলা গড়িয়ে এলে,তখন হাতের কাছে খেয়ে নিলেন একখানা বার্গার বা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর খাবার। সহজলভ্য বিরিয়ানি, তেহারি বা মোরগ পোলাওয়ের মতো পদ খাওয়া হয়ে গেল বেশ কয়েকটা দিন, বেশ কয়েক বেলা।
বিয়েতেই শেষ না
বিয়ের পর শুরু হয় একটানা আত্মীয়স্বজনের বাসায় দাওয়াতের পালা। সেখানেও চলতে থাকে নানা পদের মুখোরচক ভূরিভোজের আয়োজন। নবদম্পতি একটু নিজেদের মত সময় কাটাতে ইচ্ছে করলে সেই কোনো না কোনো রেস্তোরাঁয় যাওয়া, সঙ্গে অবধারিতভাবে কিছু বাড়তি খাওয়াদাওয়া। মধুচন্দ্রিমায় নতুন দেশে গিয়ে নিত্যনতুন পদ চেখে দেখার লোভটাও সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ে। মোদ্দাকথা, বিয়ের আয়োজনের শুরু থেকে বিয়ে–পরবর্তী বেশ কয়েকটা দিন একটানা উচ্চ মাত্রায় ক্যালরি গ্রহণ হয়েই যায়। আবার এই বাড়তি ক্যালরি পোড়ানোর সুযোগটাও এ সময়ে একটু কম থাকে। এতসবের মধ্যে শরীরচর্চার সময় কোথায়, বলুন! সব মিলিয়ে ওজনটা তাই বাড়তেই থাকে।
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
বিয়ের পর জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন আসে। নবদম্পতিরা একসঙ্গে সময় কাটানোর কারণে একে অপরের খাবারের অভ্যাসগুলো গ্রহণ করতে শুরু করেন। একসঙ্গে খাওয়ার আনন্দ এবং বিভিন্ন নতুন খাবার চেষ্টা করার আকাঙ্ক্ষা থাকার কারণে অনেক সময় বেশি খাওয়া হয়ে যায়। যেমন, নিয়মিত বাইরে খাওয়া বা বিশেষ অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত পরিমাণে খাবার খাওয়া অনেকের জন্য সাধারণ অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়। এই অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণের ফলে ওজন বাড়তে থাকে।
মনের ব্যাপারস্যাপার
বিয়ে তো কেবল আনন্দের উপলক্ষই নয়, এ হলো জীবনের এক নতুন অধ্যায়। একজন মানুষের সঙ্গে নিজের জীবনটাকে ভাগ করে নেওয়া। বিয়েতে দায়িত্বও বাড়ে। নতুন জীবনে মানিয়ে নেওয়াটাও চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। জীবনসঙ্গীর কিছু ব্যক্তিগত বিষয় অপছন্দ হতে পারে। শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের সঙ্গে কিছুটা মতপার্থক্য দেখা দিতে পারে। সামাজিক কারণেই বরের চেয়ে বউয়ের জন্য এই বিষয়গুলো সামলে নেওয়াটা একটু বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে। তবে এই সব মিলিয়ে মনের ওপর খানিকটা প্রভাব পড়তে পারে বর–কনে দুজনেরই। আর এই কারণে তাঁদের একটু বেশি খাওয়ার প্রবণতা দেখা দিতে পারে কিংবা উচ্চ ক্যালরিযুক্ত, মুখরোচক খাবারের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হতে পারে।
শারীরিক ব্যায়ামের অভাব
বিয়ের আগে অনেকে নিজেদের ফিটনেসের দিকে বেশি মনোযোগ দেন, বিশেষ করে বিয়ের দিনকে সামনে রেখে। কিন্তু বিয়ের পর অনেকেই শারীরিক ব্যায়াম বা নিয়মিত ফিটনেস রুটিন মেনে চলতে পারেন না। নতুন সম্পর্ক, নতুন দায়িত্ব, এবং সংসারের অন্যান্য চাপে শারীরিক ব্যায়ামের জন্য সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে, ক্যালোরি পুড়ার হার কমে যায় এবং ওজন বৃদ্ধি ঘটে।
মানসিক স্বস্তি এবং সম্পর্কের নিরাপত্তা
বিয়ের পর অনেকেই মানসিকভাবে স্বস্তি অনুভব করেন এবং সম্পর্কের নিরাপত্তায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। এই মানসিক স্বস্তি অনেক সময় শারীরিক যত্নের প্রতি উদাসীনতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক মানুষই বিয়ের আগে নিজের শরীর এবং ফিটনেসের প্রতি যতটা মনোযোগী ছিলেন, বিয়ের পরে সেই মনোযোগ হারিয়ে ফেলেন। সম্পর্কের নিরাপত্তা থাকায় অনেকেই নিজেদের সৌন্দর্য বা আকর্ষণীয়তা নিয়ে কম চিন্তিত থাকেন, ফলে ওজন নিয়ন্ত্রণ করার আগ্রহ কমে যেতে পারে।
মানিয়ে নেওয়ার আরও ব্যাপার
নতুন পরিবারের খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়তে পারেন কেউ কেউ। সে ক্ষেত্রে সহজ সমাধান হয়ে দাঁড়ায় সহজলভ্য বাইরের খাবার কিংবা শুকনা খাবার। বিস্কুট, কুকিজ, কেক, বাটারবান বা এ–জাতীয় অন্যান্য খাবার বেশি খাওয়া হতে পারে। সামাজিক নিয়মের কারণেই নারীরা এমন সমস্যায় বেশি পড়ে থাকেন। কারও কারও ঘুমের ব্যাঘাতও ঘটতে পারে। সে ক্ষেত্রেও উচ্চ ক্যালরিযুক্ত (হালকা স্ন্যাকস) গ্রহণের প্রবণতা বাড়তে পারে।
হরমোনাল পরিবর্তন
বিয়ের পর হরমোনের পরিবর্তনও ওজন বৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হতে পারে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে গর্ভধারণের প্রস্তুতি এবং এর পরে হরমোনের ভারসাম্য পরিবর্তন হতে থাকে। এর ফলে মেটাবলিজমের গতি কমে যায় এবং ওজন বাড়তে থাকে। এছাড়া গর্ভধারণের সময় ও পরে শরীরে ফ্যাটের সঞ্চয় বেড়ে যায়, যা ওজন বৃদ্ধির প্রধান কারণ হতে পারে। একইভাবে পুরুষদের ক্ষেত্রেও টেস্টোস্টেরনের মাত্রা হ্রাস পেলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন
বিয়ের পর দম্পতিরা সাধারণত একসঙ্গে খাবার প্রস্তুত এবং গ্রহণ করেন। একে অপরের পছন্দ-অপছন্দের প্রভাব পড়তে শুরু করে খাদ্যাভ্যাসে। যিনি আগে স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতেন, তিনিও হয়তো সঙ্গীর সঙ্গে ফাস্ট ফুড, তৈলাক্ত বা মিষ্টি জাতীয় খাবার খেতে শুরু করেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, দম্পতিরা একসঙ্গে থাকতে শুরু করলে তাদের খাদ্যাভ্যাসে মিল থাকে এবং দুজনেরই ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে।
গর্ভাবস্থা এবং সন্তান পালন
নারীদের ক্ষেত্রে বিয়ের পর গর্ভধারণ একটি সাধারণ ঘটনা, যা ওজন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। গর্ভাবস্থায় নারীদের শরীরে ফ্যাটের সঞ্চয় বেড়ে যায় এবং সন্তান জন্মের পর অনেক নারীর পক্ষে সেই ওজন কমানো কঠিন হয়ে পড়ে। সন্তান লালন-পালনের সময় ঘুমের অভাব, শারীরিক অবসাদ এবং মানসিক চাপও ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। সন্তান জন্মের পর অনেক সময় নারীরা নিজেদের শারীরিক যত্নের জন্য পর্যাপ্ত সময় পান না, ফলে ওজন কমানোর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।
নারীরাই পড়েন যে সমস্যায়
জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতির সঙ্গেও ওজনের নারীদের ওজন বৃদ্ধির সম্পর্ক রয়েছে। হরমোনযুক্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন কিংবা জন্মনিয়ন্ত্রণ ইনজেকশন গ্রহণ করা হলে ওজন বাড়তে পারে। এজন্য উচিত জন্মনিয়ন্ত্রণপদ্ধতি গ্রহণের আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া ভালো। কোন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিটি আপনার জন্য সেরা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা তাহলে সহজ হবে।
মানসিক চাপ এবং অবসাদ
বিয়ের পর সম্পর্কের দায়িত্ব, পারিবারিক চাপ, কর্মজীবন ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখা অনেক সময় মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। মানসিক চাপের ফলে অনেকেই কমফোর্ট ফুডের দিকে ঝুঁকে পড়েন, যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। অবসাদ বা মানসিক ক্লান্তির কারণে শারীরিক ব্যায়ামেও অনীহা চলে আসে, ফলে শারীরিক ফিটনেস কমে যায় এবং ওজন বাড়ে।
ঘুমের অভাব
বিয়ের পর জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন আসে, যা ঘুমের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। নতুন দায়িত্ব, সন্তান পালন বা কর্মজীবনের চাপের কারণে ঘুমের ঘাটতি তৈরি হতে পারে। ঘুম কম হলে শরীরের মেটাবলিজম কমে যায় এবং ক্যালোরি পুড়ার হার কমে যায়। এর ফলে ওজন বাড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত ঘুম না হলে শরীরে ক্ষুধা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়, ফলে অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়।
স্ন্যাকসের প্রতি আসক্তি
অনেক দম্পতি বিয়ের পর একসঙ্গে টিভি দেখার সময় বা অবসর সময়ে স্ন্যাকস খেতে পছন্দ করেন। এই স্ন্যাকস সাধারণত উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত এবং অস্বাস্থ্যকর হয়ে থাকে। এই ধরনের অস্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস নিয়মিত খেলে শরীরে অতিরিক্ত ক্যালোরি জমা হতে থাকে, যা ওজন বাড়ার অন্যতম কারণ।
বয়সের প্রভাব
বিয়ের পর সময়ের সাথে সাথে মানুষের বয়স বাড়তে থাকে, যা শরীরের মেটাবলিজমের উপর প্রভাব ফেলে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মেটাবলিজমের গতি কমে যায়, ফলে শরীরে ক্যালোরি জমা হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। তাছাড়া বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রাও কমে যেতে থাকে, যা ওজন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হতে পারে।
সম্পর্কের আনন্দ
বিয়ের পর অনেক দম্পতি সম্পর্কের আনন্দে এতটাই মগ্ন হয়ে যান যে তারা নিজেদের শারীরিক ফিটনেস বা খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সচেতন থাকেন না। সুখী এবং স্বাচ্ছন্দ্যময় সম্পর্ক অনেক সময় অতিরিক্ত খাওয়া এবং কম শারীরিক পরিশ্রমের দিকে ধাবিত করে, যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
পারিবারিক এবং সামাজিক চাপ
বিয়ের পর নবদম্পতিদের পারিবারিক এবং সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে হয়। এসব অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের খাবার পরিবেশন করা হয়, যা সাধারণত উচ্চ ক্যালোরিযুক্ত এবং তৈলাক্ত হয়ে থাকে। অনেক সময় সামাজিক কারণে বা অতিথির অনুরোধে অতিরিক্ত খাবার খাওয়া হয়, যা ওজন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।
সমাধানের উপায়
বিয়ের পর ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু সচেতন পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে:
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখা: বিয়ের পরও স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। অস্বাস্থ্যকর খাবার কমিয়ে প্রচুর পরিমাণে শাক-সবজি, ফল এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম: শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করার চেষ্টা করা উচিত। যোগব্যায়াম, জিম বা হাঁটাহাঁটি, যেটাই হোক না কেন, শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকার অভ্যাস বজায় রাখতে হবে।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ: বিয়ের পর মানসিক চাপ কমানোর জন্য মেডিটেশন বা রিল্যাক্সেশনের অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে। মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম: ঘুমের ঘাটতি পূরণ করতে হবে। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত, যা শরীরের মেটাবলিজম সঠিক রাখার জন্য অপরিহার্য।
পারস্পরিক সমর্থন: দম্পতিদের একে অপরকে শারীরিক ফিটনেস এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে সহায়তা করা উচিত। একে অপরের সঙ্গী হয়ে ব্যায়াম করা বা স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যেতে পারে।
বিয়ের পর ওজন বৃদ্ধির প্রবণতা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়, তবে সচেতন থাকলে এবং কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব।
আরও পড়ুন শরীরে লবণ কম থাকলে কী কী হতে পারে?
1 thought on “বিয়ের পর কেন মোটা হয়ে যায়”