কাঁদার মতো পরিস্থিতি, অনুভূতি বা স্মৃতি মানুষের জীবনে মাঝে মাঝে চলে আসে, কিন্তু কাঁদা সবসময় খারাপ কিছু নয়। কাঁদার মাধ্যমে আমরা আমাদের মনের ভার বা মানসিক চাপ হালকা করতে পারি। কান্না মানুষের আবেগ প্রকাশের ভাষা। আবেগতাড়িত হয়ে কান্নাকাটি করেননি, এ রকম মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন। মাঝেমধ্যে কাঁদবেন করা খুব স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। এর রয়েছে অনেক উপকারিতা ।পরিসংখ্যান দেখা গেছে যে নারীরা প্রতি মাসে পাঁচবার কাঁদেন আর পুরুষেরা একবার। এই পার্থক্যটা সামাজিক ও লৈঙ্গিক কারণে হয়ে থাকে।
মানুষ কেন কাঁদে?
মানুষ অনেক কারণেই কাঁদতে পারে, কিন্তু মূল কারণটা হলো আবেগ।
১. শারীরিক কারণ
কান্না আমাদের স্বাভাবিক শরীরকে চাপ কমাতে সাহায্য করে।
২. মনস্তাত্ত্বিক কারণ
কান্নার মাধ্যমে দুঃখ, আনন্দ, হতাশার মতো আবেগ প্রকাশ করে মানুষ। আর মানুষ যদি কাঁদতে না পারত তাহলে আবেগগুলো চাপা থাকার কারণে মানুষ বিভিন্ন জটিলতায় ভুগত।
৩. সামাজিক কারণ
কান্নার মাধ্যমে অন্যদের কাছে আমাদের সমর্থন, সহানুভূতি, সান্ত্বনা প্রকাশ করতে পারি,যদিও লজ্জায় তা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করে না। এর ফলে আমাদের সামাজিক বন্ধন শক্তিশালী হইয়ে থাকে।
৪. আনন্দ: অত্যন্ত আনন্দময় মুহূর্তেও কান্না চলে আসে। যেমন: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সফলতা লাভ, প্রিয়জনের সাথে পুনর্মিলন বা কোনো সুন্দর স্মৃতির পুনরাবৃত্তি।
৫. স্ট্রেস বা চাপ: অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা উদ্বেগ মানুষকে সহজেই আবেগপ্রবণ করে তুলতে পারে, যা কান্নার রূপে প্রকাশ পায়।
কান্নার ১০ উপকারিতা
মনোবিদেরা বলছেন কান্নাকাটি করাটা ‘হেলদি’। কান্নার পরে আমরা ভালো বোধ করি। কারণ, আবেগ ও চাপ থেকে মুক্তি দেয় কান্না। কান্নার বেশ কিছু উপকারিতা আছে, চলুন জেনে নিই:
১. প্রশান্তি এনে দেয়
চিৎকার করে বা নীরবে—যেভাবেই কান্নাকাটি করুন না কেন, দেখবেন আপনার মন কিছুটা হালকা লাগছে। কারণ, কান্না আপনাকে প্রশান্তি দিতে পারে। কান্না আমাদের প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে। বিভিন্ন হরমোনের নিঃসরণ, হজম ও সেরে ওঠার সঙ্গে জড়িত উপাদান গুলো ,যা স্নায়ু শিথিলীকরণের জন্য দায়ী । কান্নার মাধ্যমে মন শান্ত হয়, কারণ এতে এনডোরফিন এবং অক্সিটোসিন হরমোন নিঃসৃত হয়, যা সুখী অনুভূতির জন্য দায়ী।
২. ব্যথা উপশম করে
কান্নাকাটি করার ফলে শরীরে এন্ডোরফিন উৎপন্ন হয়, যা কিছু কিছু ব্যথাও উপশম করে। কান্নাকাটি আপনার প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্রকেও সক্রিয় করে, যা শিথিলতা বাড়ায়, স্ট্রেস বা চাপ কমায় এবং ব্যথা উপশম করে।
৩. মুড ভালো করে
কান্না আবেগ দমন করে আপনার মুড ভালো করে দিতে পারে। কান্না নিজের আবেগ ও মনের অবস্থা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায় বলে মনে করেন মনোবিদেরা। এতে নিজের দুর্বলতা এবং শক্তির দিকগুলো বোঝা সহজ হয়, যা আত্মউন্নয়নে সহায়ক। কান্নার মাধ্যমে আপনি প্রকারান্তরে ক্ষতিকর হরমোনগুলো শরীর থেকে বের করে দিয়ে ফুরফুরে হয়ে ওঠেন।
কান্নাকাটি করার সময় আমরা দ্রুত নিশ্বাস নিই, এতে মস্তিষ্ক ‘ঠান্ডা’ হয়ে অক্সিজেন নেওয়ার ক্ষমতা বেড়ে যায়।
৪. চাপ প্রশমিত করে
কান্না কর্টিসলের মতো স্ট্রেস-সম্পর্কিত রাসায়নিকগুলো বের করে দেয়,কান্না আমাদের ভেতরে জমে থাকা আবেগকে মুক্তি দেয়। দুঃখ, কষ্ট বা ব্যর্থতা থেকে মুক্তি পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় কান্না। এতে মানসিক ভারমুক্তির অনুভূতি আসে। যা আপনার শরীরকে স্বাভাবিক ও হালকা করে ডিটক্সিফাই করে দেয়। ফলে মানসিক দুশ্চিন্তা দূর হয়ে যায়।
৫. এনে দেয় প্রশান্তির ঘুম
অনেকক্ষণ ধরে কান্নাকাটির ফলে শরীরে বিভিন্ন হরমোন নিঃসরণের পাশাপাশি প্রচুর শক্তি ক্ষয় হয়। মাঝেমধ্যে পানির ঘাটতি দেখা দেয়। যার ফলে মাথা ঠান্ডা হয়ে একধরনের প্রশান্তি বোধ করবেন, এটা আপনাকে শান্তিপূর্ণ ও নিরবচ্ছিন্ন ঘুম দিতে পারে। তাই ঘুমানোর আগে মাঝেমধ্যে একটু কান্নাকাটি করতেই পারেন!
৬. ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে
চোখের পানিতে লাইসোজাইম নামক একধরনের অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল এনজাইম রয়েছে। লাইসোজাইম ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করে আপনার চোখকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।
৭. চোখ সুস্থ রাখে, উন্নত করে দৃষ্টিশক্তি
কান্নাকাটি চোখকে স্বাভাবিকভাবে পিচ্ছিল করে, শুষ্কতা প্রতিরোধ করে, কর্নিয়া থাকে আর্দ্র ও পরিষ্কার। ফলে সংক্রামক ব্যাধির ঝুঁকি কমে। চোখের জল ধুলাবালু ও অন্য বিরক্তিকর পদার্থগুলো ধুয়ে ফেলতে সাহায্য করে এবং সংক্রমণের ঝুঁকি হ্রাস করে। এ ছাড়া নেত্রনালি সতেজ করে চোখকে আরাম দেয় কান্না।
৮. মানসিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে
কান্না রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। অনেক সময় বন্ধু বিয়োগ হলে বা ব্রেকআপ হলে আমরা কান্নায় ভেঙে পড়ি। তখন মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ও চাপ কাজ করে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে মানসিক ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে কান্না।
৯. শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাস ও ঘুমাতে সাহায্য করে
শিশুর কান্নার শব্দ শুনতে কি কারো ভালো লাগে? কিন্তু কান্নাকাটি শিশুদের জন্যও উপকারী। এটি শিশুদের শ্বাসনালি পরিষ্কার করে। বেশি বেশি অক্সিজেন নিতে সহায়তা করে। এতে তার কষ্ট লাঘব হয়। ‘ছন্দোবদ্ধ’ কান্না শিশুর শ্বাসপ্রশ্বাসকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ঠিক বড়দের মতোই কান্নাকাটির পর শিশুদের চাপ ও দুশ্চিন্তা কমে যায়, ফলে সে রিল্যাক্সড হয়। ঘুম ভালো হয়।
১০. সামাজিক বন্ধন
কখনো কখনো কান্না মানুষের মধ্যে গভীর সম্পর্ক তৈরি করে। প্রিয়জনের সামনে কান্না করে নিজের দুর্বলতাকে প্রকাশ করা গেলে, অন্যরা আরও সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে এবং সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
সংক্ষেপে, কান্না শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটি শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সক্রিয় রাখে এবং মনের ভারমুক্তি প্রদান করে, যা সুস্থ ও সুখী জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
আরও পড়ুন প্রথমবার ডেটে যাবেন,তাহলে মনে রাখুন
2 thoughts on “কাঁদবেন কেন? কান্নার ১০ উপকারিতা”