হিজবুল্লাহ কারা, আক্রমণের স্বামর্থ্য কতটুকু

হিজবুল্লাহ কারা, ইসরায়েলকে আক্রমণের স্বামর্থ্য কতটুকু

আন্তর্জাতিক
Spread the love

হিজবুল্লাহ (Hezbollah) একটি লেবাননের শিয়া ইসলামিক রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন। হিজবুল্লাহর আবির্ভাব মূলত ১৯৮০ এর দশকে, ইসরায়েল বিরোধিতাকে কেন্দ্র করে। লেবাননে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ এর গৃহযুদ্ধকালে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয় হিজবুল্লাহ।

১৯৮২ সালে ইসরায়েলের লেবানন আক্রমণের পর, ইরানের সমর্থনে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। লেবাননের পার্লামেন্ট ও সরকারে দলটির উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। সংগঠনটি প্রথমে একটি প্রতিরোধ বাহিনী হিসেবে কাজ শুরু করে, যার মূল লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলি আক্রমণ ও দখলের বিরুদ্ধে লড়াই করা। পরবর্তীতে এটি একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল ও সামরিক বাহিনীতে পরিণত হয়।

ইসরায়েল সম্প্রতি হিজবুল্লাহর অবস্থান লক্ষ্য করে চালানো প্রাণঘাতী বিমান হামলায় কয়েক শ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। চলমান হামলায় দুটি দেশের মধ্যে চরম উত্তেজনা কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক পর্যায় বিরাজ করছে। এজন্য বিশ্ব ব্যাপী আবার হিজবুল্লাহ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

ইসরায়েলের সঙ্গে আগে লড়াই করেছে

হিজবুল্লাহ একটি শিয়া মুসলিম রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র গোষ্ঠী। দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী সশস্ত্র বাহিনীকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তারা।লেবাননের দক্ষিণ ও রাজধানী বৈরুতের অংশবিশেষে ইসরায়েল হামলা চালানোর পর হিজবুল্লাহও দেশটির উত্তরাঞ্চলে কয়েক শ রকেট ছুড়ে জবাব দিয়েছে। অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে শুরু হওয়া সংঘাত এখন লেবানন হয়ে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক সংঘাতে রূপ নেওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে।

ইরানের কাছ থেকে অনেক বছর ধরেই আর্থিক ও সামরিক—উভয় দিক থেকে জোরালো সমর্থন পেয়ে আসছে হিজবুল্লাহ। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদেরও ঘনিষ্ঠ মিত্রও গোষ্ঠীটি।

হিজবুল্লাহর সশস্ত্র শাখা ইসরায়েলি বাহিনী ও লেবাননে মার্কিন বাহিনীকে লক্ষ্য করে একাধিকবার প্রাণঘাতী আক্রমণ চালিয়েছে। লেবানন থেকে ২০০০ সালে ইসরায়েল যখন সেনা প্রত্যাহার করে, তখন হিজবুল্লাহ তাদের দেশছাড়া করার কৃতিত্ব দাবি করে। পরে সীমান্তের বিরোধপূর্ণ এলাকাগুলোতেও ইসরায়েলের অবস্থানের বিরোধিতা অব্যাহত রাখে সশস্ত্র সংগঠনটি।

ইসরায়েল–লেবানন সীমান্তে হিজবুল্লাহর তৎপরতাকে ঘিরে ২০০৬ সালে পুরোদস্তুর যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েল। ওই যুদ্ধে ইসরায়েলি সেনারা দক্ষিণ লেবাননে ঢুকে পড়েন এবং সেখান থেকে হিজবুল্লাহর হুমকি নির্মূল করার চেষ্টা চালান। লড়াইয়ে প্রাণ হারান প্রায় এক হাজার বেসামরিক লোক। লড়াইয়ে হিজবুল্লাহ জয়ী হওয়ার দাবি করে এবং তখন থেকেই নিজেদের যোদ্ধার সংখ্যা বাড়ানো ও অস্ত্রশস্ত্র সমৃদ্ধ করা শুরু করে তারা। পশ্চিমা দেশ, ইসরায়েল ও উপসাগরীয় আরব দেশগুলো হিজবুল্লাহকে একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়ে রেখেছে।

হিজবুল্লাহর রাজনৈতিক সমর্থন কতটা

হিজবুল্লাহ লেবাননে জাতীয় নির্বাচনে নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে ১৯৯২ সাল থেকে এজন্য প্রধান রাজনৈতিক সংগঠন নিজেদের অবস্থা জানান দিয়েছে তারা। ২০২২ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হিজবুল্লাহ ও এর মিত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। তবে তখন থেকে লেবাননে কোনো নতুন সরকার গঠিত হয়নি। দেশটি চলছে তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের অধীনে।

হিজবুল্লাহকে নিয়ে লেবাননের বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে গভীর বিভক্তি। যদিও বাস্তবে হিজবুল্লাহর ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে, তবু অনেক সমালোচনাকারীর অভিযোগ, সংগঠনটি রাজনৈতিকভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত। এর সামরিক সক্ষমতার বিরোধিতাও করে থাকেন তাঁরা। হিজবুল্লাহকে তাঁরা দেশের চলমান সংঘাতের জন্য দায়ী উল্লেখযোগ্য একটি পক্ষ হিসেবেও দেখেন।

একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে হিজবুল্লাহ লেবাননজুড়ে বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল পরিচালনা করে।

হিজবুল্লাহ কতটা শক্তিশালী

হিজবুল্লাহর হাজার হাজার যোদ্ধা রয়েছে। আছে দক্ষিণ লেবাননে ক্ষেপণাস্ত্রের বিশাল সম্ভার। বিশ্বের অন্যতম সশস্ত্র বেসরকারি সামরিক সংগঠন হিসেবেও হিজবুল্লাহকে ধরা হয়। সংগঠনটিকে অর্থ ও অস্ত্রসরঞ্জাম দিয়ে সহায়তা করে ইরান। হিজবুল্লাহর দাবি, তাদের যোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ। যদিও নিরপেক্ষ সূত্রের অনুমান, এটি ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার।

হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা সুপ্রশিক্ষিত ও যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে লড়াই করেছেন এ বাহিনীর সদস্যরা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, হিজবুল্লাহর ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ২ লাখ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে।

অস্ত্রভান্ডারে থাকা হিজবুল্লাহর এসব রকেটের বেশির ভাগই আকারে অনেক ছোট,  যা ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য করা যায়। তবে সশস্ত্র সংগঠনটির বিমান ও যুদ্ধজাহাজবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র এবং ইসরায়েলের একেবারে ভেতরে আঘাত হানতে সক্ষম ‘গাইডেড’ ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গাজার সশস্ত্র সংগঠন হামাসের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র রয়েছে লেবাননে হিজবুল্লাহর রয়েছে  ।

হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরুল্লাহ কে

১৯৯২ সাল থেকে হিজবুল্লাহর শিয়া নেতা হাসান নাসরুল্লাহ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠায় করার জন্য তাঁর  গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ।

ইরান ও এর সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির সঙ্গেও হাসান নাসরুল্লাহর রয়েছে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। নাসরুল্লাহ কয়েক বছর ধরেই জনসমক্ষে আসছেন না। ইসরায়েলের হাতে হত্যার শিকার হওয়া থেকে বাঁচতেই তিনি লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন বলে মনে করা হয়।

প্রকাশ্যে না এলেও হিজবুল্লাহর কাছে নাসরুল্লাহর আবেদন যথেষ্ট রয়েছে। প্রতি সপ্তাহে সম্প্রচার করা হয় তাঁর টেলিভিশন ভাষণ। হিজবুল্লাহ–ইসরায়েল সাম্প্রতিকতম সংঘাত। গত ৩০ জুলাই ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী (আইডিএফ) ঘোষণা করে, বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে তাদের এক বিমান হামলায় হিজবুল্লাহর জ্যেষ্ঠ সামরিক কমান্ডার ফুয়াদ শোকর নিহত হয়েছেন।

পরদিন ফিলিস্তিনের হামাসপ্রধান ইসমাইল হানিয়া ইরানের রাজধানী তেহরানে হামলায় নিহত হন। এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করা হলেও এটি স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটিই করেনি দেশটি। এরপর গত ২৫ আগস্ট আইডিএফ দাবি করে, সংগঠনটি তাদের জ্যেষ্ঠ নেতা ফুয়াদ হত্যার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে—এমনটা জানতে পেরে লেবাননের দক্ষিণে সংগঠনটির হাজারো রকেট লঞ্চার লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে তারা।

ওই ঘটনায় হিজবুল্লাহ ও ইসরায়েলে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ে। সংগঠনটি বলেছে, ইসরায়েলে শত শত রকেট ও ড্রোন হামলা চালাতে সক্ষম তারা। তবে তারা দেশটির প্রধান প্রধান শহরকে নিশানা বানায়নি এবং অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রও ব্যবহার করেনি। দুপক্ষের সাম্প্রতিকতম উত্তেজনা বেড়ে গেছে গত ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর লেবাননে হাজারো পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের ঘটনায়। এসব বিস্ফোরণে ৩৯ জন নিহত ও কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন।

ওই আক্রমণের জন্য হাসান নাসরুল্লাহ ইসরায়েলকে দায়ী করে বলেছেন, ‘ইসরায়েল সব রেডলাইন অতিক্রম করেছে।’ ২০ সেপ্টেম্বর বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে ইসরায়েলের আরেকটি বিমান হামলায় শীর্ষস্থানীয় দুই সেনাকমান্ডার ইব্রাহিম আকিল ও আহমেদ ওয়াহবিসহ সংগঠনটির অন্তত ১৬ সদস্য নিহত হন। হামলায় নিহত হয় কয়েকটি শিশুসহ অন্যান্য বেসামরিক লোক।

এই ঘটনার দুদিন পর হিজবুল্লাহ ইসরায়েলের একেবারে ভেতরে দূরপাল্লার রকেট নিক্ষেপ করে। এতে হাইফা শহরের কাছে কিছু বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হামলা থেকে বাঁচতে হাজারো ইসরায়েলি আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেন। এদিকে গত সোমবার থেকে লেবাননে বড় ধরনের হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল। ওই দিন হিজবুল্লাহর প্রায় ৩০০ অবস্থান লক্ষ্য করে চালানো হামলায় কমপক্ষে ৩৫ শিশুসহ ৬১৩ জন নিহত হন। আহত হয়েছে হাজারের উপর মানুষ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *