অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার খবর যখন শুনেছিল দেশবাসী, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন তিনি সম্ভবত সরকারের মেয়াদকাল ও নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে কিছু বলবেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। অন্তর্বর্তী সরকারকে সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে হবে। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে জরুরি সংস্কারের খাতগুলো এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ।
নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষিত হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও স্বাভাবিক হয়ে পড়বে, দেশবাসী নির্বাচনের মুডে চলে আসবে। আর সেক্ষেত্রে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারও নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দেশ শাসন করতে পারবে; তা না হলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে বৈ কমবে না।
অবশ্য সেনাপ্রধান দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক ধরনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। সরকার শুধু সংস্কারের কথাই বলে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের পক্ষে রয়েছে, তবে নির্বাচন অনুষ্ঠানেরও তাগিদ রয়েছে তাদের পক্ষ থেকে। রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়া হলো, সংস্কারের কাজগুলো তাদের সঙ্গে আলোচনা অন্তর্বর্তীকালীন বা অন্তর্বর্তী সরকার এমন একটি সরকার, যা কোনো স্থায়ী সরকারের পতনের পর কিংবা নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য গঠিত হয়।
এর প্রধান লক্ষ্য হল রাজনৈতিক অস্থিরতা বা সংকটকালীন সময়ে দেশে একটি স্থিতিশীল প্রশাসন বজায় রাখা এবং নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন সরকারের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা। অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কাজ করে এবং তাদের ক্ষমতা সীমিত থাকে। তারা সাধারণ প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজের আওতা
নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করা। তারা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে, যাতে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, ভোটের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা এবং নির্বাচনের দিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখা। তারা কোনো দলীয় পক্ষপাতদুষ্টতা ছাড়াই এ দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য।
আইন শৃঙ্খলা রক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। সাধারণত সরকার পতনের পরে দেশ অস্থিরতা বা উত্তেজনার মধ্যে থাকে। তাই জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং অপরাধ দমন করা অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পুলিশ, সামরিক বাহিনী, এবং অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করে অন্তর্বর্তী সরকার।
দলীয় পক্ষপাতমুক্ত প্রশাসন পরিচালনা
অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যরা সাধারণত কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকেন না। তারা নিরপেক্ষতার সাথে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করে এবং কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষপাতিত্ব না করে দেশের সার্বিক কল্যাণে কাজ করেন। এ ধরনের সরকার জনগণের আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সংবিধান ও আইন অনুসরণ
অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান ও প্রযোজ্য আইনের আওতায় কাজ করে। তাদের কাজ হল রাষ্ট্র পরিচালনার নিয়মকানুন মেনে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করা এবং আইন অনুযায়ী কাজ করা। তারা কোনো নতুন আইন প্রণয়ন বা পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখে না, তবে প্রচলিত আইনের আওতায় কাজ করে থাকে। কোনো বড় ধরনের প্রশাসনিক সংস্কার বা নীতি পরিবর্তনেরও ক্ষমতা তাদের নেই।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে এবং তাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে। তাদের কাজ হলো নির্বাচনী মাঠে সমান সুযোগ তৈরি করা, যাতে কোনো দল সুবিধা বা অসুবিধার সম্মুখীন না হয়। পাশাপাশি তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রচারণার সময় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব পালন করে।
বেসামরিক প্রশাসন ও নিত্য প্রয়োজনীয় সেবা পরিচালনা
অন্তর্বর্তী সরকার সময়কালে দেশের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজগুলো নির্বিঘ্নে চালিয়ে যাওয়া তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। এটি অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ এবং পরিবহন খাতের ব্যবস্থাপনা এবং সেবাসমূহের কার্যক্রম চালু রাখা। তারা এই সমস্ত খাতে নতুন কোনো উদ্যোগ গ্রহণের পরিবর্তে চলমান সেবা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকার আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বজায় রাখে এবং দেশের কূটনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে তারা সাধারণত বড় কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষর করে না বা কূটনৈতিক নীতি পরিবর্তন করে না। তারা কেবল স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বিদ্যমান চুক্তি ও সম্পর্কগুলো রক্ষা করে এবং দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ঠিক রাখার চেষ্টা করে।
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার দিকে নজর রাখে। তারা সাধারণত অর্থনৈতিক নীতি পরিবর্তন করে না বা কোনো বড় প্রকল্প শুরু করে না। তবে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে এবং সাধারণ জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যেসব নীতি বা ব্যবস্থা ইতোমধ্যে প্রচলিত, সেগুলোর প্রয়োগ নিশ্চিত করে।
অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলা
অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রায়শই বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ সংকট মোকাবেলা করতে হয়, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক বিপর্যয় বা সামাজিক অস্থিরতা। যদিও তাদের ক্ষমতা সীমিত, তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে এবং জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে।
বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা রক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করা। তারা আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ না করে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছতা বজায় রাখে, যাতে বিচার ব্যবস্থা কোনো রাজনৈতিক চাপ বা প্রভাবের মধ্যে না থাকে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা
যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের কাজের আওতা অনেক ব্যাপক, তাদের ক্ষমতা বেশ সীমিত। কিছু সীমাবদ্ধতা হলো:
নীতি প্রণয়ন বা পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই
অন্তর্বর্তী সরকার নতুন কোনো নীতি প্রণয়ন বা বিদ্যমান নীতির পরিবর্তন করতে পারে না। তাদের প্রধান কাজ হল চলমান প্রশাসন পরিচালনা করা এবং নতুন নির্বাচনের আয়োজন করা।
দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ নিষিদ্ধ
অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন প্রকল্প বা কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে না। তাদের কাজের আওতা শুধুমাত্র দৈনন্দিন প্রশাসনিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ।
সীমিত মেয়াদ
অন্তর্বর্তী সরকার সাধারণত খুব স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করে। তাদের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় নতুন সরকার গঠনের পরই। এই সীমিত সময়ে তারা বড় কোনো প্রকল্প শুরু বা বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা রাখে না।
অন্তর্বর্তী সরকার মূলত একটি স্বল্পমেয়াদী প্রশাসনিক কাঠামো, যার কাজ দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা, নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করা। এটি একটি ভারসাম্য রক্ষার প্রক্রিয়া, যা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
আরো পড়ুন নির্বাচন কবে, জানতে চায় রাজনৈতিক দলগুলো