ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশে জ্বালানি সরবরাহ না থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে। যার ফলে গত কয়েকদিন যাবত দেশে তীব্র লোডশেডিংয়ে বির্যস্ত মানুষ। এছাড়া আমদানি নির্ভর জ্বালানি খাতে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সরকারের কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া পায় । ফলে চাহিদা মতো বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে না।
দেশে বর্তমানে উৎপাদন সক্ষমতা প্রায় ২৭ হাজার মেগাওয়াটের বেশি হলেও চাহিদা ১৬ হাজার মেগাওয়াটের কম। জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত না করে অপরিকল্পিতভাবে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। অনেক ক্ষেত্রে চাহিদাও বিবেচনায় নেয়া হয়নি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা জানান, আওয়ামী সরকার গত ১৫ বছরে অর্থনৈতিক যে বিপর্যয় বা ঘাটতি রেখে গেছে তারই ফলাফল এই পুরো বিদ্যুৎ খাত মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ে ্গিয়েছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে। সম্পূর্ণ টাকা দেয়া সম্ভব না হলেও যতটুকু টাকা দিয়ে সরবরাহ বজায় রাখা যায় ততটুকু দিতে হবে।
এদিকে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান জানিয়েছেন, সাময়িক সংকট সমাধানে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ডলার পেমেন্ট করা হচ্ছে। এই খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সংকটের মূল সমস্যা ডলার সংকট। একে কেন্দ্র করেই অন্য সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করেছে এই মুহূর্তে।
ডলার সংকট
দেশে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ আসে গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। গ্যাস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা আছে প্রায় বারো হাজার মেগাওয়াট। আগে সাড়ে ছয় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এখন সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে না।
বঙ্গোপসাগরে মহেশখালীতে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের প্রতিদিন গ্যাস আসে একশ দশ কোটি ঘনফুট । কিন্ত গত ২৭শে মে থেকে সামিটের এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ । যার ফলে এখন সরবরাহ করা যায় মাত্র ৬০ কোটি ঘনফুট। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের সব ইউনিট। ফলে গতকাল মঙ্গলবার তিন হাজার মেগাওয়াটের কাছাকাছি লোডশেডিং ছিল।
অন্যদিকে, ভারতের ঝাড়খণ্ডে নির্মিত আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আসত। যার পরিমাণ ছিল দিনে দেড় হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের আমলের বকেয়া রেখে যায়। এই বকেয়া পরিশোধ না করায় বর্তমানে প্রতদিন মাত্র এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে তারা।
শেখ হাসিনার সরকার ব্যাংক থেকে বন্ড ছেড়ে বেসরকারি খাতের বকেয়া বিদ্যুৎ বিল কিছুটা কমাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের এখনও অনেক বকেয়া রয়েছে। গ্যাস বিল, সরকারি–বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল, ভারতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিল সব কিছু মিলিয়ে পিডিবির বকেয়া টাকার পরিমাণ ৩৩ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বকেয়া অর্থ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন ভারতের আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। ১৫ শতাংশ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য গ্যাস রেশনিং করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ। তবেই লোডশেডিং এর সংকট সমাধান হতে পারে।”
জ্বালানিতে অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতা
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ খাতে পলিসিগত যে ভুল সবচেয়ে ভয়াবহ হয়েছে সেটা হলো পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা শক্তিশালী অর্থনীতির বিবেচনায় আমদানি নির্ভর করা হয়েছিল।
সদ্য বিদায়ী শেখ হাসিনার সরকার একটি ভ্রান্ত ধারণার উপর নির্ভর করে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। নতুন নতুন এসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গ্যাসের সঙ্গে তেল এবং কয়লার ব্যবহারও বাড়াতে হয়েছে। আর নতুন নতুন এসব জ্বালানি কেন্দ্রের বেশিরভাগই জ্বালানি উপকরণ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, জ্বালানির এই আমদানি নির্ভরতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। যা সরাসরি ডলারের ওপর চাপ তৈরি করেছে। জ্বালানি আমদানির জন্য ২০২২-২০২৩ সালে অতিরিক্ত ১৩ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বাকিতে দিচ্ছে। তারা নিজের খরচে জ্বালানি ক্রয় করছে। কিন্তু ফুয়েল এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের টাকাতো তাদের বাকি পড়ছে।
এ খাতের সংকট নিরসনে সরকারকে অগ্রাধিকার-ভিত্তিতে অর্থ বরাদ্দ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। যতটুকু অর্থ দিয়ে সরবরাহ বজায় রাখা যায় তা দিতে হবে।
অপরিকল্পিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও জ্বালানি সরবরাহ না থাকা
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের হিড়িক পড়ে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি আইন পাস করে এগুলোকে দায়মুক্তি দেয়া হয়। এ আইনের অধীনে দরপত্র ছাড়াই একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। ব্যবসায়ীরা ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতারাও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা নেন।
অনেক পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করা হলেও সেগুলো থেকে আশানুরূপ ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ অর্থের অভাবে গ্যাস ও তেল কেনা যাচ্ছে না। এরকম বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর চুক্তি স্থগিত বা রিনিউ করা হয়নি। দেশের দক্ষিণে চারটি বড় বড় কয়লা-চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলো হলো পায়রা, রামপাল, এস আলম এবং মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র।
এগুলোর মোট উৎপাদন সক্ষমতা পাঁচ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু সরবরাহ লাইন না থাকার কারণে এগুলো থেকে বিদ্যুৎ ঢাকার দিকে আনা যাচ্ছে না। অথচ তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়। তারা বলছেন, এখন ক্যাপাসিটির অসুবিধা নেই। কিন্তু সরবরাহ লাইনের সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না।
যা বলছেন জ্বালানি উপদেষ্টা
যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বড়পুকুরিয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র এখন বন্ধ আছে। একইসাথে আদানির কেন্দ্র থেকেও বিদ্যুতের সরবরাহ কমানো হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, “বড়পুকুরিয়াতে আমাদের একটা বিদ্যুৎ কেন্দ্র আছে এবং এই কেন্দ্রে একটা যান্ত্রিক ত্রুটি হয়েছে। আমরা আশা করতে পারি আগামী ১৮ তারিখের মধ্যে বিদ্যুৎ চলে আসবে।”
“এছাড়াও ভারতের আদানি কোম্পানি থেকে আমরা বিদ্যুৎ আনি, কিন্তু সেখানেও একটু সরবরাহ কমে গেছিল। তার জন্য আমরা যোগাযোগ করা শুরু করেছি। এবং সেজন্য গত পরশুর তুলনায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ভালো ছিল।”
এর ফলে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন জ্বালানি উপদেষ্টা। গত তিন দিনে লোডশেডিংয়ে যে পরিস্থিতি হয়েছে সেটা আর হবে না বলে জানান । সাময়িক সংকটে ইতোমধ্যেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে আমাদের আগামী ছয় সাতদিন সময় লাগবে জানিয়ে বলেন, “এছাড়া আরও দশ দিন সময় লাগতে পারে শিপমেন্টটা আসতে। তখন আমরা কিন্তু আরো বেশি গ্যাস পাবো। তখন বিদ্যুৎ সংকট আরো কমে আসবে।”
ডলার সংকটের কারণে বর্তমানে আদানীর বকেয়া বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়েছে আদানির বিদ্যুৎকেন্দ্র।