বাংলাদেশে প্রায় মাস ব্যাপি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছাত্র–জনতার বিক্ষোভ,সহিংস রক্তক্ষয়, দেশজুড়ে অশান্তি—এমন এক ঘটনা বহুল কয়েকদিনের মধ্যে সরকারপ্রধানের পদ আর দেশ দুটিই ছাড়তে হয়েছে শেখ হাসিনাকে।
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ৫ই আগস্ট সোমবার সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ভারতে চলে যান ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানাও। শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পরেই অসংখ্য মানুষ ঢাকায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ঢুকে পড়েন। ছাত্র–জনতার আনন্দ–উল্লাসের পাশাপাশি চলে লুটপাটও।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। ২০০৯ সালে সেনা সমর্থিত তত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর এত দিন টানা দেশ শাসন করেছেন তিনি। ২০০৯ সালের পূর্বে ১৯৯৬ সালে এক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা।
সব মিলিয়ে ২০ বছরের বেশি সময় শেখ হাসিনার শাসন চলেছে। তাঁর মতো একজন প্রতাপশালী প্রধানমন্ত্রীর এমন পতন ও দেশত্যাগের ঘটনা দেশে ও বিদেশে অবাক হএয়ার বিষয়।
শেখ হাসিনা লড়াকু গণতন্ত্রকামী হিসেবে নিজের রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন তিনি।
কিন্তু ক্ষমতার শেষের দিকে এসে শেখ হাসিনা ক্রমেই স্বৈরাচারী মনোভাবের হয়ে উঠেছিলেন বলে মনে করেন তার সমালোচকেরা। ভিন্নমতের কাউকে তিনি গ্রাহ্য করতেন না। যারাই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেত তাদের রাজনৈতিক গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন—সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এসবই ছিল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগ।
শেখ হাসিনা যেভাবে ক্ষমতায় আসেন
১৯৪৭ সালে গোপালগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন এবং পারিবারিক রাজনীতির উত্তরাধিকার হন।শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার রূপকার, জাতির জনক এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সেনা অভ্যুত্থানে বাবা–মা ও পরিবারের বাকি সদস্যদের হত্যা করা হয়। সেই সয়ম জার্মানিতে থাকায় দুই বোন হাসিনা ও রেহানা বেঁচে যান।
পরিবারকে হারিয়ে ও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বিদেশে অনেক বছর নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়েকে। তারপর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে শেখ হাসিনা বাবার দল আওয়ামী লীগের প্রধান হন।
শেখ হাসিনা যখন আওয়ামীলীগের প্রধান হন তখন দেশে জেনারেল এরশাদের শাসন চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একত্রিত হয়ে গণ–আন্দোলনে নামেন শেখ হাসিনা। গণতন্ত্রের দাবিতে রাজপথে আন্দোলন চালিয়ে যান। ফলে দ্রুতই গণতন্ত্রকামী জাতীয় প্রতীকে পরিণত হন বঙ্গবন্ধু কন্যা।
স্বৈরাচারী এরশাদের পতন হলেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয় পায়নি আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে ১৯৯৬সালে নির্বাচনে জিতে প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। তাঁর হাত ধরেই দুই দশকের বেশি সময় পর ক্ষমতায় ফেরে বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরোনো দল আওয়ামী লীগ।
প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে অন্তত দুটি কারণে প্রশংসিত হন শেখ হাসিনা। ভারতের সঙ্গে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থিতি শীলতা দূর করতে শান্তি চুক্তি করা।
দুইটি কারণে প্রশংসিত হলেও বেশ কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়িক চুক্তি সই এবং ভারতপন্থী অতিরিক্ত মনোভাবের কারণে সমালোচনার মুখে পড়ে শেখ হাসিনা সরকার। যার ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির কাছে পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ।
পরবর্তীতে ২০০৯ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় ফেরে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন।
রাজনীতির এই খেলায় বেশ কয়েকবার কারাগারে যেতে হয়েছে তাঁকে। হামলার শিকারও হয়েছেন বেশ কয়েকবার।বিএনপি সরকারের শাসনামলে ২০০৪ সালে ঢাকায় তাঁকে হত্যা করতে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। প্রাণে বাঁচলেও সেদিনের হামলার ভয় তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে। বিরুদ্ধী দলে থাকার সময় দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে পাঠানোর জন্য আইনি লড়াইও মোকাবিলা করতে হয়েছে তাঁকে।
শেখ হাসিনার বড় অর্জন
দরিদ্র একটি দেশকে শেখ হাসিনার শাসনামলে ধীরে ধীরে উন্নয়নের ধারায় দ্রুত চলতে শুরু করে বাংলাদেশ। বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি নজর কাড়ে সবার।
গত এক দশকে মাথাপিছু আয় তিন গুণ বাড়িয়ে বর্তমানে সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দ্রুতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংকের এক তথ্যমতে,আড়াই কোটির বেশি বাংলাদেশি দারিদ্র্যসীমা থেকে বের হতে পেরেছে গত দুই দশকে।
সেই সঙ্গে দেশজুড়ে বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে আওয়ামীলীগ সরকার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য নির্মাণ প্রকল্প ২৯০ কোটি ডলারের পদ্মা সেতু।বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়ন, ঋণ ও উন্নয়ন সহায়তার অর্থে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।
বিতর্কের মুখে শেখ হাসিনা
২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় আসার পর এবারই প্রথম এত গুরুতর আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছিলেন শেখ হাসিনা।ছাত্রদের সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত।ছাত্রদের চাওয়াকে প্রথমে অস্বীকার করলে ব্যাপক রক্তপাতের পর সেটা এক দফা বা সরাসরি সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়।
কিন্তু আওয়ামীলীগ সরকার আন্দোলন দমনে কঠোর পথ বেছে নিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের সরাসরি ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। পুলিশ ছাত্রদের উপর নির্বিচার গুলি চালায়।গুলি ও লাঠি চার্জে নিহত হন কয়েক শ মানুষ। এছাড়া হাজার হাজার মানুষকে ফৌজদারি অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ ছাড়াও হাসিনার ছাত্রলীগ,যুবলীগ,আওয়ামীলীগসহ সরকারী ব্যক্তিরা সাধারণ ছাত্রদের উপর বর্বর হামলা চালায়।
শুধু কোটা সংস্কারের দাবি নয়, এর সঙ্গে করোনা–পরবর্তী সময়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবনযাত্রার বাড়তি ব্যয়ের কারণে ক্ষুব্ধ ছিলেন সাধারণ মানুষ। মূল্যস্ফীতি ক্রমেই আকাশ্মুখী হতে শুরু করেছিল। ব্যাপক ধস নেমেছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও। ২০১৬ সালের পর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও ধস নামতে শুরু করে সঙ্গে ছিল দ্বিগুণ বিদেশি ঋণের চাপ।
সমালোচকেরা মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকারের অতিরিক্ত অব্যবস্থাপনার কারণে চারপাশ থেকে ভরাডুবি শুরু হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগে শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠজনদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণেও মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
বিশ্লেষক ও সমালোচকদের মতে,গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূল্য চুকিয়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছিলেন শেখ হাসিনা।
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর কর্তৃত্ববাদী দমন–পীড়নের অভিযোগ ছিল বেশ গুরুত্বর। অথচ এই শেখ হাসিনা একসময় রাজপথে নেমেছিল বহুদলীয় গণতন্ত্রের জন্য।
বাংলাদেশের বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিভিন্ন সময় জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে (২০০৯ সালের পরবর্তী সময়ে) বাংলাদেশে অন্তত ৬০০ গুমের পাশাপাশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক।
শেখ হাসিনার আমলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর আটক, নির্যাতনের অভিযোগ ছিল উল্লেখ্য করার মত। ২০২১ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
রাজনৈতিক ও সাধারণের সঙ্গে আটক, নজরদারি, হয়রানির শিকার হন মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিকেরাও। বিভিন্ন গণমাধ্যমকে চেপে ধরতে শেখ হাসিনার সরকার কঠোরতর আইন করে।
পতনের নেপথ্যে শেখ হাসিনা
শান্তিতে নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আদালতের মাধ্যমে বারবার ‘আইনি হয়রানি করা হচ্ছে’—শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে এটা দেশ ও বিদেশে গুরুত্বরএকটি অভিযোগ। তবে বিশ্লেষক ও সমালোচকদের মতে, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছিল শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার।
২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপির বহু জ্যেষ্ঠ নেতাকে আটক করা হয়। আরও আটক হন সারাদেশের দলটির হাজারো নেতা–কর্মী। আটক-নিযার্তনের এই কর্মকাণ্ডকে শেখ হাসিনার ভিন্ন মতামত দমনের কৌশল হিসেবে ধরা হয়।
তবে এসব অভিযোগ সব সময় অস্বীকার করে এসেছেন শেখ হাসিনা ও তার দলের মন্ত্রী আমলা নেতারা। কিন্তু এইসব অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখতে এবং তা নিয়ে প্রতিবেদন করার জন্য বিদেশি সাংবাদিকেরা বাংলাদেশে আসতে চাইলে কখনোই অনুমতি দেওয়া হয়নি শেখ হাসিনা সরকার।
যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে শেখ হাসিনা এবং তাঁর ৭৫ বছরের পুরোনা রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে এবং লাখ লাখ আওয়ামীলীগের নেতা কর্মী ও সর্থকদের।
There is definately a lot to find out about this subject. I like all the points you made