করদাতার জন্য কর মওকুফ বা করমুক্ত আয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিধান রয়েছে, যা করপদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বাংলাদেশের আয়কর আইন অনুযায়ী, করদাতার কিছু নির্দিষ্ট আয়ের ওপর কর আরোপিত হয় না। এই করমুক্ত আয়ের আওতায় ব্যক্তিগত, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় বিভিন্ন ধরনের আয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। নিচে এর বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
১. প্রত্যক্ষ করমুক্ত আয়
ক. বৈধ করমুক্ত সীমা
প্রত্যেক কর বছরের জন্য ব্যক্তি করদাতার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ আয় করমুক্ত রাখা হয়। করমুক্ত আয়সীমা নির্ধারণ করা হয় করদাতার বয়স, লিঙ্গ, প্রতিবন্ধিতা এবং অন্যান্য মানদণ্ড বিবেচনায়:
- সাধারণ করদাতা: বছরে ৩,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
- নারী এবং ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সের করদাতা: ৪,০০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি: ৪,৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত।
- বীর মুক্তিযোদ্ধা: ৪,৭৫,০০০ টাকা পর্যন্ত।
খ. গ্র্যাচুইটি বা অবসরকালীন সুবিধা
সরকারি বা বেসরকারি চাকরিজীবীদের অবসরকালীন কিছু সুবিধার ওপর কর আরোপ করা হয় না। যেমন:
- অবসরকালীন গ্র্যাচুইটি (সরকারি প্রতিষ্ঠানে পুরোপুরি করমুক্ত, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত)।
- প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ।
গ. কৃষিজ আয়
কৃষিজ আয়ের ওপর সরাসরি কোনো আয়কর নেই, তবে এর ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে ভূমি কর (খাজনা) আরোপিত হতে পারে।
ঘ. উপহারের আয়
নিকটাত্মীয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত উপহার বা সম্পত্তির ওপর কর আরোপিত হয় না। তবে এটি প্রমাণ করতে হবে যে উপহারটি আইনসম্মত।
২. আংশিক করমুক্ত আয়
ক. বেতনভুক্ত সুবিধা
কর্মীদের বেতন প্যাকেজের নির্দিষ্ট কিছু সুবিধা আংশিক করমুক্ত, যেমন:
- চিকিৎসা ভাতা: মাসিক সর্বোচ্চ নির্ধারিত সীমা পর্যন্ত।
- পরিবহন ভাতা: নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত করমুক্ত।
খ. বিনিয়োগ আয়
নির্দিষ্ট কিছু বিনিয়োগের আয়ের ওপর কর মওকুফ দেওয়া হয়, যেমন:
- জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে প্রাপ্ত আয়ের নির্ধারিত সীমা।
- নির্দিষ্ট শিল্প বা অঞ্চলে বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত আয়।
৩. শিক্ষাগত ও সামাজিক উদ্দেশ্যে প্রাপ্ত আয়
ক. শিক্ষাবৃত্তি
শিক্ষার্থীরা শিক্ষাবৃত্তি থেকে প্রাপ্ত অর্থের ওপর কর দিতে হয় না। তবে এই সুবিধাটি শুধুমাত্র নির্ধারিত নিয়মের অধীনে প্রাপ্ত বৃত্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
খ. অলাভজনক প্রতিষ্ঠান
অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের আয় করমুক্ত হতে পারে যদি প্রতিষ্ঠানটি আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিবন্ধিত হয়।
৪. দান ও অনুদান প্রাপ্তি
কোনো নির্দিষ্ট দাতব্য, ধর্মীয় বা অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে প্রদত্ত অর্থ বা অনুদান করমুক্ত হতে পারে। এটি সাধারণত করপোরেট বা ব্যক্তিগত করদাতাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
৫. বিশেষ সরকারি সুবিধা
কিছু বিশেষ শ্রেণির ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান করমুক্ত সুবিধা পেয়ে থাকেন:
- কূটনীতিক বা আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মকর্তা।
- বিদেশি নাগরিকদের নির্দিষ্ট আয় (যা বাংলাদেশ সরকারের চুক্তির আওতায় আসে)।
৬. অভ্যন্তরীণ প্রণোদনা বা করছাড়
সরকার কিছু সেক্টর বা কার্যক্রমে প্রণোদনা দিয়ে কর মওকুফ করে থাকে। উদাহরণস্বরূপ:
- পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি উৎপাদন।
- তথ্যপ্রযুক্তি খাত।
করমুক্ত আয়ের শর্তাবলী
১. করমুক্ত আয়ের উৎস বৈধ হতে হবে।
২. নির্ধারিত নথি এবং হিসাব-নিকাশ প্রমাণস্বরূপ উপস্থাপন করতে হবে।
৩. আয়ের পরিমাণ এবং ধরন অবশ্যই নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকতে হবে।
করমুক্ত আয়ের গুরুত্ব
করমুক্ত আয়ের ব্যবস্থা করদাতাদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করে এবং সামাজিক সমতা বজায় রাখে। এটি প্রয়োজনীয় খাতগুলোর জন্য আর্থিক সুবিধা প্রদান করে এবং জনগণের আয়কর ব্যবস্থার প্রতি আস্থা বাড়ায়।
সুতরাং, করমুক্ত আয়ের সঠিক ব্যবহার এবং আইনানুগ প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলা সম্ভব।
আরও পড়ুন প্রতিদিন চা খাওয়া ভালো না খারাপ