তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনার) আবেদন করা হয়েছে। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।২০১১ সালে জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসহ সংবিধানে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়। এর আগে পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে তা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না কেন তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছে হাইকোর্ট।
এই দুইটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার একটি ভিত তৈরি হলো বলে মনে করছেন রিটকারীদের একজন বদিউল আলম মজুমদার।
রিভিউ আবেদনে যা চাওয়া হয়েছে
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের চাপে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় সংসদে পাস করে বিএনপি যা ছিল ত্রয়োদশ সংশোধনী । এর দুই বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করা হয়।
পরে ২০০৪ সালে বিএনপি সরকারের সময়ে সেই রিট খারিজ হলে এ ব্যবস্থা বহালই থাকে। পরের বছর এর বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। এরপরে ২০০৭ সালে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আবার আপিল শুনানি শুরু হয়।
তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকসহ সাত বিচারপতির আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ ২০১১ সালের দশই মে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। পরের বছর সেপ্টেম্বরে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।আপিল বিভাগের ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সম্প্রতি আবেদন করা হয়েছে। রিভিউ আবেদন করার কারণ সম্পর্কে আবেদনকারীদের আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ জাজমেন্টের আমরা রিভিউ চেয়েছি কারণ এটার অনেকগুলো আইনগত ত্রুটি আছে”।
এ রায়ের মধ্যে পরস্পরবিরোধী বিষয় আছে জানিয়ে তিনি বলেন, “ যেমন প্রথম সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়েছিল আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করতে হবে। কিন্তু পরে বিস্তারিত আদেশে আগের ধারা বাতিল করে দেওয়া হয়,যা ছিল একটা পরস্পরবিরোধী”।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি দেশের গণতন্ত্র সুসংগঠিত করে, জনগ্ণের ভোটাধিকারকে সুসংহত করে, এগুলো সংবিধানের মূল কাঠামো উল্লেখ করে বলে জানান আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া। আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই অধিকার গুলো সুনিশ্চিত করে। এজন্য আপিল বিভাগ রায় দিয়ে এটা বাতিল করতে পারে না ”।
আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করতে গিয়ে কিছু ক্ষমতা ব্যবহার করেছে যেগুলো বিচার বিভাগ বা নির্বাহী বিভাগে করার কথা। এটা ক্ষমতা পৃথকীকরণ নীতির পরিপন্থী ছিল বলে মনে করেন । এ আবেদনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হলো কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,আমাদের দেশের সাংবিধানিক সংস্কারের একটা অংশ হিসেবে এটাকে দেখতে চাই।
যারা এই রিভিউ আবেদনটি করেছেন তারা মূল আপিল মামলায় পক্ষভুক্ত ছিলেন না। সুপ্রিম কোর্টের অবকাশকালীন ছুটির পর অক্টোবরে তারা শুনানির জন্য উদ্যোগ নেবেন বলে জানান আইনজীবী।
কেন রিভিউ চাওয়া হয়েছে ?
সুশাসনের জন্য নাগরিকের(সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার, স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খানসহ পাঁচজন এ রিভিউ আবেদনটি করেছেন। সুজনের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “ সবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী ছিল সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। জনগ্ণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া ও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে অকার্যকর করা হয়েছিল। তাই আমরা আশা করছি পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল হয়ে যাবে। কিন্তু বাতিল হলেও একটা অস্পষ্টতা থেকে যায়”।
আমরা ত্রয়োদশ সংশোধনীও বাতিলের মাধ্যমে অস্পষ্টতা দূর করার জন্যরিভিউয়ের আবেদন করেছি। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনেক অন্যায় করা হয়েছে, সেগুলোর বিহিত হওয়া দরকার উল্লেখ করে জনাব মজুমদার আরো বলেন, “এর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরে আসবে, এটা একটা ভিত তৈরি করবে। যার ভিত্তিতে বর্তমান সরকার বিভিন্ন সংস্কার করতে পারবে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে।”
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী নিয়ে রুল
এর আগে গত ১৯শে অগাস্ট সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী কেন সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে রুল দেয় হাইকোর্ট। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে এ রিটটি করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচজন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় রিভিউ চেয়ে তারাই আবেদন করেছেন।
একইসাথে দুটো প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে জনাব মজুমদার বলেন, “ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত আগের রায় যদি বাতিল হয় তবে পঞ্চদশ সংশোধনী থেকে যাচ্ছে। এ সংশোধনীও বাতিল হওয়া দরকার। দুটোই বাতিল হতে হবে। যেহেতু অসাংবিধানিকভাবে সংসদে এটা পাস করা হয়েছে সেটাও প্রমাণ করা দরকার”। সে সময় রিটকারীর আইনজীবী শরীফ ভুঁইয়া বলেন, “সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একসঙ্গে অনেকগুলো অনুচ্ছেদে পরিবর্তন বা সংশোধনী আনতে হলে গণভোট করতে হবে”।
“ গণভোট না করে সংশোধনী পাস করা সংবিধান পরিপন্থী” এ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের অনেকগুলো অনুচ্ছেদের পরিবর্তন আনা হয়। কিন্তু কোন গণভোট করা হয় নি।। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপসহ কয়েকটি বিষয়ে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়। ওই বছরের ৩রা জুলাই এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের রায় নিয়ে কী হয়েছিল?
এ মামলাটি ত্রয়োদশ সংশোধনীর মামলা নামে পরিচিত। কারণ এ রায়ের মাধ্যমেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এনে সংবিধানের যে ত্রয়োদশ সংশোধনী আনা হয় তা বাতিল করা হয়। ওই সময় প্রধান বিচারপতি ছিলেন এ বি এম খায়রুল হক। ২০১১ সালের ১০ই মে আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এক সংক্ষিপ্ত আদেশে বলেছিল, জাতীয় সংসদ চাইলে আরো দুইটি নির্বাচন (দশম ও এগারতম) তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে।
ওই সংক্ষিপ্ত আদেশের ১৬ মাস পরে ২০১২ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর যখন পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয় তখন এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি পদ থেকে অবসর নেন। তিনি যে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করেন তাতে পরবর্তী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকার বিষয়টি ছিল না। এমনকি, সরকারের মেয়াদ শেষ হলেও সংসদ বহাল থাকার কথাও যুক্ত হয় পূর্ণাঙ্গ রায়ে। সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ের এই বিশাল অসংগতি নিয়ে তখনই জোরালো বিতর্ক উঠেছিল।
পূর্ণাঙ্গ রায়ে সঙ্গে একমত হয়েছেন বিচারপতি এস কে সিনহা,বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন,বিচারপতিএ বি এম খায়রুল হক এবং বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দেন বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা।
তবে বিচারপতি মো. ইমান আলী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে মত না দিয়ে বিষয়টি জাতীয় সংসদের ওপর ছেড়ে দেন।
উন্মুক্ত আদালতের রায় পরিবর্তন করা যায় কী?
হাইকোর্টের বেশ কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জানান, বিচারপতি খায়রুল হকের দেয়া এ রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক আলোচনা সভায় সাবেক প্রধান বিচারপতি মাহমুদুল আমীন চৌধুরী বলেছিলেন, আমি মনে করি না অবসরের পর রায় লেখা বেআইনি।
পদ্ধতিগত কারণসহ আরও কিছু কারণে আপিল বিভাগের রাইয় দিতে দেরি হতে পারে তবে সেটা যৌক্তিক সময়, এক মাসের মধ্যে হতে পারে। অবশ্যই এক-দেড় বছর বা তার বেশি হতে পারে না। আর অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ রায়ে আদেশের অংশ কোনো ভাবেই পরিবর্তন করা যাবে না। সেটা করতে গেলে পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন ও শুনানি হতে হবে। কিন্তু তা না করেই যদি রাতের অন্ধকারে, এক-দেড় বছর পর রায় পরিবর্তন করে ফেলেন, তাহলে সেটা ফৌজদারি অপরাধ।
হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী জানান আপিল বিভাগের রুলসেই বলা আছে উন্মুক্ত আদালতের রায় পরিবর্তন করা যায় না। আপিল বিভাগের রুলসেই বলা আছে উন্মুক্ত আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে দেয়া রায় পরিবর্তন করা যাবে না। তবে, শুধু মাত্র কোন গ্রামাটিক্যাল সংশোধন বা ভুল থাকলে তা করা যাবে” ।
হাইকোর্টের এই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মি. চৌধুরী মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই বিষয়টা আদালতে আনা ঠিক হয় নি। রাজনৈতিকভাবেই এর ফয়সালা হওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন তিনি।