তীব্র গণআন্দোলনের মুখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বহু শাসক ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে যাবার নজির রয়েছে। জনরোষ থেকে আত্মরক্ষার জন্যই মূলত দেশ ছেড়ে যাবার পথ বেছে নিয়েছিলেন তারা।
এদের মধ্যে অনেকেই কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচন ছাড়া বহু বছর ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে বসেছিলেন। কেউ কেউ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হবার পরে স্বৈরশাসকদের মতো আচরণ করেছে। বিশ্বে পতিত স্বৈরাচারদের পরিবার থেকে রাজনীতিতে ফিরে আসে। কেউ কেউ আবার রাজনীতির মারপ্যাঁচে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।
লিবিয়ার গাদ্দাফি
লিবিয়ার ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী নেতা, যিনি বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন, তার ছেলে সাইফ আল-ইসলাম গাদ্দাফি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নেবেন। লিবিয়ায় ২০২৪ সালে দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার কথা রয়েছে, যদিও সেটি নিয়ে অনিশ্চয়তা এখনো রয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার ময়াম্মার গাদ্দাফির ছেলে সাইফ আল ইসলাম গাদ্দাফি রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারেন বলে । ২০১১ সালে গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত ও হত্যা করার পর তার ছেলে সাইফ আল গাদ্দাফি বিদ্রোহীদের হাতে আটক হয়েছিলেন।
তিনি প্রায় ছয় বছর বিদ্রোহীদের হাতে আটক ছিলেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে তিনি লিবিয়ার জিনতান প্রদেশ থেকে মুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গণহত্যার বিচার চলছে। কিন্তু এরই মধ্যে তিনি লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
মিশরের হুসনি মুবারক
স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে মরুময় আরব বিশ্বে যে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন মিশরের হুসনি মুবারক, যিনি একটানা ৩০ বছর অবৈধভাবে ক্ষমতায় ছিলেন।
মিশরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট হুসনি মুবারকের ছেলে গামাল মুবারকের পক্ষে অনলাইন প্রচারণা শুরু করেন অনেক মিশরীয়। অনেকে তাদের ফেসবুক এবং টুইটার অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন, মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও চলমান অর্থনৈতিক সংকট কাটানোর জন্য গামাল মুবারক একমাত্র সমাধান। সামাজিক ফ্লাটফর্মে প্রচারণার মাধ্যমে তারা মিশরের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গামাল মুবারককে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দেখতে চান বলে জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে গামাল মুবারক শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেনি।
বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি প্রায় ৮৯ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় রয়েছেন। যদিও সে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে প্রচুর। অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, গামাল মুবারক ভবিষ্যতে মিশরের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবেন। ২০১১ সালে হুসনি মুবারকের পতনের পর তার সাথে দুই ছেলেকেও গ্রেফতার করা হয়। এরপর ২০১৭ সালে গামাল মুবারক কারাগার থেকে ছাড়া পান।
ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তো
১৯৯৮ সালে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সুহার্তো। তার ক্ষমতাচ্যুতির পরে দেশটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে পড়ে। সুহার্তো ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার ১৬ বছর পরে ২০১৪ সালের নির্বাচনে তার মেয়ে সিতি হেদাইতি সুহার্তো, যিনি তিতেক সুহার্তো হিসেবে পরিচিত, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলেন।
সে নির্বাচনে তিনি বলেছেন, তার বাবা সুহার্তো ক্ষমতা ছাড়ার পরে দেশে তেমন কোন অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়নি। নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি বাবার ইমেজ তুলে ধরার চেষ্টা করছেন বারবার। সুহার্তোর ছেলে টমি সুহার্তো একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন ২০১৬ সালে। সেই দলে সুহার্তোর মেয়ে যুক্ত থাকলেও পরবর্তীতে তিনি সেই দল থেকে অব্যহতি নেন।
এই পার্টির নেতা হচ্ছেন তার সাবেক স্বামী। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে সুহার্তোর মেয়েকে দলটির উপদেষ্টা বানানো হয়েছিল। সে নির্বাচনে তার স্বামী প্রাবোউ সুবিনাতো জয়লাভ করেন। সুহার্তো ক্ষমতায় থাকার সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ছিল সুবিনাতোর বিরুদ্ধে। তখন তিনি স্পেশাল ফোর্সের কমান্ডার ছিলেন।
সুহার্তোর পতনের পর সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় মি. সুবিনাতোকে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে সুবিনাতোকে আমেরিকায় নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
ফিলিপিন্সের মার্কোস
ফিলিপিন্স-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট ফার্ডিন্যান্ড ই মার্কোস ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। ক্ষমতাচ্যুত হাবার পর তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানে করে গুয়াম দ্বীপে আশ্রয় নেন।
মার্কোস ২১ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। স্বৈরাচার মার্কোস ক্ষমতাচ্যুত ও পালিয়ে যাবার ৩৬ বছর পরে ২০২২ সালে তার ছেলে ফার্ডিন্যান্ড মার্কোস জুনিয়র ফিলিপিন্স-এর প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। নির্বাচনের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, দেশের ভেতরে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করবেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনা। নির্বাচনে তিনি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছিলেন। নির্বাচনের সময় তিনি অনলাইন প্রচারণার মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন তার বাবার শাসনামলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি এবং স্থিতিশীলতা এসেছিল।
থাইল্যান্ডের থাকসিন
২০০৬ সালে একটি টেলিকম কোম্পানি বিক্রয়কে কেন্দ্র করে থাকসিন শিনাওয়াতের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। যার ফলে থাইল্যান্ডের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন শিনাওয়াতকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল দেশটির সেনাবাহিনী।
দেশটিকে ২০০৫ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে থাকসিন শিনাওয়াতের দল বিপুল জয় পেয়েছিল। কিন্তু তখন তিনি বিদেশে থাকা অবস্থায় সেনাবাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করে। এরপর থাকসিন শিনাওয়াত ও তার রাজনৈতিক দলকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়।
নির্বাচনে প্রতারণার অভিযোগে থাকসিন শিনাওয়াতের দলের আরো ১১১ জন নেতাকে পাঁচ বছরের জন্য রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর মি. থাকসিন ব্রিটেনে স্বেচ্ছা নির্বাসনে চলে যান। থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ধনকুবের থাকসিন শিনাওয়াতের মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে দেশটির পার্লামেন্ট।
৩৭ বছর বয়সী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা হবেন দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তার ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে সামরিক অভ্যুত্থান বা সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। তার বাবা থাকসিন শিনাওয়াত এবং ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রাসহ অপর তিনজনকে। এর আগে ২০১১ সালে থাকিসন সমর্থিত একটি রাজনৈতিক দল ফিউ থাই পার্টি নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং তার বোন ইংলাক শিনাওয়াত প্রধানমন্ত্রী হন।
পাকিস্তানের নওয়াজ শরীফ
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের রাজনৈতিক জীবন বেশ উত্থান-পতনের ভেতরে দিয়ে যাচ্ছে। তিনবার ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বারবারই ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন নওয়াজ শরীফ। কারগিল যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন সেনা প্রধানের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন নওয়াজ শরীফ। এরপর সেনাপ্রধান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। এরপর তাকে বিচারের মাধ্যমে কারাদণ্ড দেয়া হয়।
তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এবং সৌদি বাদশাহ ফাহাদ বিন আব্দুলাজিজের মধ্যস্থতায় ছাড়া পেয়ে স্বেচ্ছা নির্বাসনে সৌদি আরব চলে যান ২০০২ সালে। ২০০৭ সালেও তিনি ফিরে এসেছিলেন, যখন তিনি ও তার প্রতিপক্ষ বেনজীর ভুট্টো সেনাবাহিনীর সাথে এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে আসেন।
১৯৯৯ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা হারানোর পর আবারও তাকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয়। এরপর ২০১৩ সালের নির্বাচনে আবারো ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরীফ। কিন্তু ২০১৭ সালে আবার পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজ শরিফকে অযোগ্য ঘোষণা করে।
নওয়াজ শরীফ তিন বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন, এবং তিন বারই তিনি মেয়াদ শেষ হবার আগেই ক্ষমতা হারিয়েছেন – প্রথমবার রাষ্ট্রপতির সাথে দ্বন্দ্বের জের ধরে পদত্যাগ করেছেন, দ্বিতীয়বার সেনাবাহিনী তাঁকে হটিয়েছে, এবং ২০১৭ সালে আদালতের মাধ্যমে। ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) এর নির্বাচনি স্লোগান ছিল ‘পাকিস্তান কো নওয়াজ দো’, অর্থাৎ ‘পাকিস্তানকে নওয়াজ দাও’।
যদিও শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী মনোনীত হয়েছেন নওয়াজ শরিফেরই ভাই শেহবাজ শরিফ। এরপর ২০২৪ সালের নির্বাচনে নওয়াজ শরীফের দল ৭৫ আসনে জয়লাভ করে। পরে রাজনৈতিক শরীকদের নিয়ে সরকার গঠন করা হলে তার ভাই শেহবাজ শরীফ প্রধানমন্ত্রী হন।
কেন ফিরে আসে?
স্বৈরশাসকরা বিভিন্ন কারণে আবার রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারে। এর পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট কাজ করে। স্বৈরশাসকরা সাধারণত ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজনীতিতে ফিরে আসতে চায়। ক্ষমতার প্রতি তাদের আকর্ষণ শক্তিশালী, এবং তারা ক্ষমতাসীন না থাকলে প্রভাব হারানোর ভয় পায়। আবার কিছু স্বৈরশাসক তাদের শাসনের সময় জনগণের একটা অংশের সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়। তারা তাদের কার্যক্রমকে “স্থিতিশীলতা” এবং “অগ্রগতির” প্রতীক হিসেবে তুলে ধরে। আবারো ক্ষমতায় ফিরে আসার সময় তারা এসব জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগায়।
অনেক দেশে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল থাকে, ফলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে সহজেই ভেঙে ফেলা যায়। এর ফলে স্বৈরশাসকদের ফিরে আসা সহজ হয়, বিশেষ করে যখন সুশাসনের অভাব দেখা দেয়। যখন গণতান্ত্রিক সরকারগুলি দুর্বল হয় বা নিজেদের মধ্যে বিভক্ত হয়, তখন স্বৈরশাসকরা এই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে আবার ফিরে আসে। যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হয় বা জনগণের আস্থা হারায়, তখন স্বৈরশাসকরা আবার ফিরে আসার সুযোগ পায়। সামরিক বা প্রভাবশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর সমর্থন পায়। এই গোষ্ঠীগুলি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য স্বৈরশাসকদের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরতে সাহায্য করে।
স্বৈরশাসক প্রোপাগান্ডা এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নিজেদের শাসনকালে অর্জিত সাফল্য এবং স্থিতিশীলতা প্রচার করে। ফলে জনগণের মাঝে তাদের প্রতি পুনরায় আস্থা জন্মাতে পারে। এছাড়াবিরোধী দল বা নেতারা যদি বিভক্ত, দুর্বল, বা জনসমর্থনহীন থাকে, স্বৈরশাসকরা রাজনীতিতে সহজেই ফিরে আসতে পারে। স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে মানুষের এক ধরণের আক্রোশ কিংবা ঘৃণা থাকলেও তাদের পরিবারের সদস্যরা পরবর্তীতে কিভাবে রাজনীতিতে ফিরে আসেন?
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, যখন কোন দেশে দীর্ঘদিন যাবত গণতন্ত্র থাকেনা তখন সে দেশে বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে ওঠার সুযোগ তৈরি হয় না। ফলে স্বৈরশাসকদের পতনের পর যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে তারা থাকে রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অনভিজ্ঞ। এতে করে সবকিছু বুঝে উঠতে তাদের সময় লাগে। ফলেও সমস্যা দীর্ঘায়িত হতে থাকে এবং জনগণের ধৈর্যচ্যুতি হয়।