আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রূপরেখা চাইছে বিএনপিসহ কোনো কোনো রাজনৈতিক দল । কিন্তু নির্বাচনের দিন-তারিখ নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি সরকারের পক্ষ থেকে। যদিও আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন হতে পারে বলে আভাস দিচ্ছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের কেউ কেউ।
সর্বশেষ শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল শনিবার বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) উদ্যোগে আয়োজিত এক সম্মেলনে অংশ নিয়ে বলেছেন, ‘আমাদের এই সরকার খুবই স্বল্পকালীন। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করি, রাজনৈতিকভাবে আগামী বছরেই আমরা একটি নির্বাচিত সরকার দেখব।
গত ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর। এই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের ওপর জোর দেয়। তবে বিএনপি দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দাবি করে আসছে। জামায়াতে ইসলামী শুরুতে নির্বাচনের তাগিদ না দিলেও গত কয়েক দিনে দলটির আমির শফিকুর রহমান দুবার দ্রুত সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের কথা বলেছেন।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্যরা বরাবরই বলে আসছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কারের পর নির্বাচন হবে। তবে সংস্কার কতটুকু হবে, তা নির্ভর করবে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর।
রাজনৈতিক দলগুলোর সূত্র বলছে, নির্বাচন কবে হবে এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট কোনো ঘোষণা না এলেও বিষয়টি এখন সব মহলে আলোচিত। হয়তো সামনের দিনগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে একটা সময়সীমা পাওয়া যাবে।
গত ২১ নভেম্বর অবসরপ্রাপ্ত সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠন করা হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনের প্রশ্নে এক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে বলে রাজনৈতিক মহল মনে করছে। এর আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগে ৩১ অক্টোবর সার্চ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকেই নতুন ইসি গঠন করা হয়।
গত ১৭ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনীয় কিছু অত্যাবশ্যকীয় সংস্কারকাজ শেষ করেই নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। তবে নির্বাচনের জন্য সরকার ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে, এটা আর থামবে না চলতেই থাকবে। এই ট্রেন যাত্রায় চলমান অবস্থায় আমাদের অনেক কাজ করে যেতে হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যেতে যেতে অনেকগুলো কাজ সেরে ফেলতে হবে—এটা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা আসলে সংস্কারকাজের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সংস্কার কতটুকু করা হবে, এর ওপরই নির্বাচন কবে হবে তা নির্ভর করছে।
নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, সংবিধান, দুর্নীতি দমনসহ ১০টি বিষয়ে সংস্কারের জন্য সরকার কমিশন গঠন করেছে। বেশির ভাগ কমিশন চলতি ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের সুপারিশ দিতে পারে। আর সংস্কার কমিশনের সুপারিশ পেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারে সরকার।
সরকারের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় কোন কোন খাতে কী কী সংস্কার করা হবে, তা ঠিক করা হবে। সংস্কারের জন্য কত সময় লাগবে, সেই সময়সীমারও ধারণা পাওয়া যাবে। তখনই এর একটা প্রকৃত সময় জানা যাবে আসলে নির্বাচন কবে সম্ভব ।
সরকারের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে গত ১৯ নভেম্বর আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘আমরা অতি প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব। আমরা জাস্ট এই জিনিসটা চাই না যে আগের মতো কোনো ভুয়া নির্বাচন হোক। আর এটা চাই না—নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কেউ আবার ভুয়া নির্বাচন করার সুযোগ পাক। এটা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নাই।’
এরপর ২১ নভেম্বর সরকারের নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে বলেছিলেন, ২০২৬ সালের মাঝামাঝি কাঙ্ক্ষিত ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হতে পারে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে।
গত ২৪ সেপ্টেম্বর রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান পরবর্তী ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারণার কথা জানান। সেনাপ্রধান বলেছিলেন, সে জন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
এদিকে ২৪ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জানানো হয়, আগামী নির্বাচন কবে হবে, তা প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হবে। এ নিয়ে বাকি যাঁরা কথা বলছেন, সেগুলো তাঁদের ব্যক্তিগত মতামত।
প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বারবারই বলছে, দ্রুত নির্বাচন না হলে দেশের সংকট কাটবে না। জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন নিয়ে এত দিন তাগাদা না দিলেও দলটির আমির গত ২৯ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, ন্যূনতম সংস্কার শেষে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত। কুমিল্লায় এক কর্মী সম্মেলনে গত শুক্রবার আবারও দ্রুত সংস্কার শেষে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন জামায়াতের আমির।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে ঐক্যের ডাক দিয়ে যৌথ সংলাপ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়া করলে চলবে না। আবার অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণও ঠিক হবে না। সরকারের উচিত প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো কবে নাগাদ শেষ হবে, এর একটা পথনকশা প্রকাশ করা। তিনি মনে করেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রশাসন, পুলিশকে তৈরি করা এবং নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি একসঙ্গে চালাতে হবে।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয় উল্লেখ করে অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ বলেন, বর্তমান সরকারের বৈধতা ও সক্ষমতা দুটোই আছে। এরপরও এমন সব পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, যা নির্বাচিত সরকার ছাড়া মোকাবিলা করা কঠিন। ফলে নির্বাচিত সংসদ ও সরকার গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন ১৬ হাজার খুন আওয়ামী লীগের শেষ ৫ বছরে