পাঁচ ভাই, এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় মো. মোস্তাফিজুর রহমানের আয়ের শুরুটা হয়েছিল গৃহশিক্ষক হিসেবে, ছাত্রজীবনে। ২০০৪ সালে শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে আজ তিনি থিতু সুনামগঞ্জের ধর্মপাশা উপজেলার সেলবরষ ইউনিয়নের বাদশাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে। এই কলেজে ইংরেজির প্রভাষক তিনি। অবাক করার মতো বিষয় হলো কলেজশিক্ষক এই মোস্তাফিজুর রহমানের মাসে আয় প্রায় দুই লাখ টাকা। গ্রামের একটি অখ্যাত ডিগ্রি কলেজে শিক্ষকতা করে এতো টাকা আয় করা কীভাবে সম্ভব? মাসে গড়ে দুই লাখ টাকা আয় করা মো. মোস্তাফিজুর রহমান এটা সম্ভব করেছেন অনলাইনে মাসে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং কাজের মাধ্যমে।
বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের নিয়মিত কর্মীর বাইরে মুক্তপেশাজীবী বা ফ্রিল্যান্সারদের দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ করিয়ে নেন। এটিই ‘ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং’ নামে পরিচিত। গ্রাহকের নির্দিষ্ট কাজ নির্ধারিত সময়ে কাজ করে দেন ফ্রিল্যান্সাররা। মোস্তাফিজুর রহমান এমন কাজই করেন চারজনের একটি দল নিয়ে। ধর্মপাশায় বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা পণ্যের বর্ণনা লিখে দেয় মোস্তাফিজুর ও তাঁর দল। লিখতে হয় ইংরেজিতে। কারিগরি ভাষায় এই বিষয়টিকে বলে ‘কনটেন্ট রাইটিং’। সাত বছর আগে কন্টেন্ট রাইটিং দিয়ে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করেছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান।
শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখি
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে সফলতা পেলেও শিক্ষকতাকে এখনো মূল পেশা হিসেবে রেখেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। দুটি কাজেই স্বাচ্ছন্দ্য তিনি। ২০১০ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে বাদশাগঞ্জ ডিগ্রি কলেজে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক হিসেবে কর্মরত মোস্তাফিজুর রহমান। শিক্ষকতার পেশায় থাকার ইচ্ছে পেষণ করে,তিনি বলেন, শিক্ষকতার সঙ্গে লিখালেখির কাজ চালিয়ে নিতে চাই। শিক্ষার্থীদের লিখালেখির ব্যাপারে পুরো উৎসাহ দিইয়ে যাচ্ছি। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কীভাবে তাঁরা সফল হতে পারে, সে বিষয়ে তাদের সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে যাচ্ছি।’
শিক্ষক ছাড়া নিজেকে কখনোই অন্য কিছু ভাবতেন না মোস্তাফিজুর রহমান। যত চাকরির আবেদন করেছেন জীবনে, সবই শিক্ষকতার আবেদন। তবে তাঁর সৃজনশীল লেখালেখির অভ্যাস ছিল । ২০১৬ সালে নেত্রকোনা সরকারি কলেজে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণির অতিথি প্রভাষক হিসেবে ক্লাস নেন। তাঁর পড়াশোনা ও লেখালেখির প্রতি একটা ঝোঁক আছে, তাই এক সহকর্মী হঠাৎই তাকে পরামর্শ দেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে লেখালেখি শুরু করার। চিন্তাভাবনা করে শুরু করলেন ফ্রিল্যান্সিং। ছাত্রজীবনেই ২০০০ সালে, টিউশনির টাকা দিয়ে একটি কম্পিউটার কেনা ছিল মোস্তাফিজুরের।
ভুল থেকে শেখা
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ দেওয়া–নেওয়ার ওয়েবসাইট (অনলাইন মার্কেটপ্লেস) আপওয়ার্কে নিজের একটি অ্যাকাউন্ট খুলে প্রোফাইল বানালেন মোস্তাফিজুর রহমান। তাঁর ইচ্ছা ছিল এভাবে নিজের লেখালেখির হাতটাও ঝালাই করে নেবেন। আপওয়ার্কে প্রোফাইল খোলার পর সহজেই কিছু কাজ পেয়েছিলেন মোস্তাফিজুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘১০-১৫ দিনে তিন হাজার টাকা আয় করেছিলাম, এটা মনে আছে। সহজে কাজ পাওয়ার উত্তেজনায় আরও বেশি কাজের জন্য আবেদন করতে থাকি। কিন্তু আপওয়ার্কের নীতিমালা অনুযায়ী আবেদন ও কাজের সাড়া পাওয়ার নির্দিষ্ট অনুপাত থাকতে হয়। সেটা না হলেই রিপোর্ট করে দেবে।’ সেটাই হলো মোস্তাফিজুর রহমানের ক্ষেত্রে। সঠিক অনুপাতে সাড়া না পাওয়ায় নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়ে মোস্তাফিজুর রহমানের প্রোফাইল। পুনর্বিবেচনার জন্য আপিল করেছিলেন তিনি। প্রোফাইল ফিরে পেতে লেগে গেল তিন মাস।
মোস্তাফিজুর রহমান যখন এই লেখালেখি শুরু করেন তখন বাংলাদেশের অ্যাফিলিয়েট মার্কেটার বা ব্লগাররা ভালো অবস্থানে ছিলেন। তাঁদের অনেক লেখকের প্রয়োজন ছিল। লেখকদের ভালো একটি সম্মানীও দিচ্ছিলেন তাঁরা। এ কারণে মোস্তাফিজুর রহমান আর আপওয়ার্কে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ পাননি।
নিজের লেখালেখির দক্ষতা মোস্তাফিজুর রহমান ফ্রিল্যান্সিংয়ে কাজে লাগালেন। কম হলেও প্রথম দিন থেকে টাকা আয় করছিলেন তিনি। তবে অর্থের চেয়ে কাজের নেশা পেয়ে বসেছিল তাঁকে। সরাসরি নিজের জন্য কিছু করার প্রয়োজনীয়তা থেকে শুরু করে দিলেন নিজের নামে ব্লগ অর্থাৎ ওয়েবসাইট খুলে সেখানে বিভিন্ন বিষয়ে লিখতেন।
ধর্মপাশা থেকে ফ্রিল্যান্সিং
চাকরি সূত্রে নেত্রকোনায় ছিলেন এক বছরের মতো। ২০১৯ সালে বিয়ে করলেন। স্ত্রী মাহাবুবা ইসলামের কর্মস্থল সিলেটে। ওদিকে মোস্তাফিজুর রহমান তখন ধর্মপাশার কলেজে যোগ দিয়েছেন। তাঁকে সিলেট ও সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় যাতায়াত করতে হতো। ব্লগ লেখা ও প্রকাশের বেলায় বড় সমস্যা ছিল ইন্টারনেটের ধীরগতি। নিবন্ধ প্রকাশ বা আপলোড করতে ঝামেলাই হতো। ‘কনটেন্ট রাইটিং’ বিষয়ে নিবন্ধ মানে তো শুধু লেখা নয়। ইনফোগ্রাফ, ছবি–ভিডিও দিতে হত সেখানে। তাই তীব্রভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়ল উচ্চগতির ইন্টারনেটের। ‘স্বাধীন ওয়াই–ফাই এ সময় হাত বাড়াল ’ ইন্টারনেট সংযোগ প্রতিষ্ঠান। দেশের অতি প্রত্যন্ত এলাকায় উচ্চগতি সম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ দেয় তারা। সংযোগ লাগানোর পর পুরোদমে ব্লগ লেখার কাজ করতে থাকেন মোস্তাফিজুর রহমান।
লিখে আয় ভালো হলেও একটা অতৃপ্তি রয়েছে মোস্তাফিজুর রহমানের। কারণ, ৯০ শতাংশ লেখাতেই লেখক হিসেবে তাঁর নাম থাকে না। তবে ইদানীং পরিচিতি বাড়ছে তাঁর, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁর নাম যুক্ত হচ্ছে।
দুবাইভিত্তিক একটি অটোমোবাইল প্রকল্পে এখন যুক্ত হয়েছেন মোস্তাফিজুর রহমান। মূল গ্রাহক অবশ্য একজন বাংলাদেশি। এই প্রকল্পের ৮–১০ জন লেখকের একটি দলের মান নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করছেন মোস্তাফিজুর রহমান। সহজ ভাষায় তিনি সম্পাদনার কাজ করেন। পাশাপাশি তাঁকে লেখার বিষয়, ডিজিটাল বিপণন, ব্যবসা উন্নয়ন, এসইও ইত্যাদি প্রযুক্তিগত দিকগুলোও দেখতে হয়।