জামায়াতে ইসলামী (Jamaat-e-Islami) হলো একটি ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল, যা মূলত দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সক্রিয়। দলটি প্রতিষ্ঠা করেন সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদুদী ১৯৪১ সালে অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতে। জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন রূপে সক্রিয়।
বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করে আসছে। দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আদর্শের ভিত্তিতে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়। দলটির বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, এবং বেশ কিছু নেতাকে দণ্ডিত করা হয়েছে। জামায়াতে ইসলামী সাধারণত ইসলামী আইন (শরিয়াহ) প্রতিষ্ঠার পক্ষে এবং ইসলামী মূল্যবোধের প্রচার ও প্রসারের লক্ষ্যে কাজ করে। দলটির অনেক শাখা ইসলামী পুনর্জাগরণ এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারের জন্য কাজ করে।
ইসলামপন্থীদের নিয়ে নির্বাচনী ঐক্য
পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়ার চিন্তা করে ‘নির্বাচনী ঐক্য’ গড়তে ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের সঙ্গে জোট করতে চায় জামায়াতে ইসলামী। অন্তত পাঁচটি ইসলামি দল এবং আলেমদের সঙ্গে এ লক্ষ্যে দলটি ইতিমধ্যে পৃথক বৈঠক করেছে। জামায়াত সূত্র জানিয়েছে, বিএনপির সঙ্গে বনিবনা হওয়ার সম্ভাবনা কম—এমনটা ধরে নিয়ে দলের নীতিনির্ধারণী নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিতব্য সংসদ নির্বাচনে ইসলামপন্থীদের সঙ্গে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়তে চাইছেন। যদিও বর্তমানে দৃশ্যমান চূড়ান্ত কোনো রূপ লাভ করেনি বলে বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের প্রেক্ষাপটে প্রায় সাড়ে ১৫ বছর পর স্বাভাবিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে ফিরেছে ধর্মভিত্তিক দল জামায়াতে ইসলামী। এই মুহূর্তে দলটি সারা দেশে ঘরোয়া কার্যক্রমে ব্যস্ত। তবে দীর্ঘদিনের ‘ফেরারি’ অবস্থান থেকে হঠাৎ করে রাজনীতির সম্মুখভাগে আসা জামায়াতকে নিয়ে অনেকের মধ্যে নানা আলোচনা সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের কিছু বক্তব্য ও তৎপরতায় কিছুটা সংশয়-সন্দেহ তৈরি করেছে বিএনপিতে।
এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির নেতৃত্বের দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকে। দল দুটির সাম্প্রতিক তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করে তাঁরা বলছেন, এটি এখন অনেকটা স্পষ্ট যে বিএনপি সংস্কার শেষে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায়। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের গতি কিছুটা ধীর। তারা দ্রুত নির্বাচন আয়োজনের চেয়ে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। এ জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে আগ্রহী জামায়াতের নেতৃত্ব। দল দুটির এই ভিন্ন অবস্থান আগামী দিনের রাজনীতি ও নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে।
ইতিমধ্যে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক বক্তব্যে বলেছে, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির কোনো জোট নেই। যদিও ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর থেকে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে বিএনপি। এরপর ২০-দলীয় জোটের দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করলেও জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্যে আর সম্পর্ক গড়েনি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের ‘এক দফা’ দাবিতে গত ২৬ জুলাই বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামি রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের প্রতি ‘জাতীয় ঐক্যের’ যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাতে দল দুটির মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। জামায়াত বিবৃতি দিয়ে বিএনপির আহ্বানে সাড়া দেয়।
জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জামায়াতের নেতৃত্ব সংসদ নির্বাচন নিয়ে এখনই অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর কোনো চাপ তৈরি করতে চাইছেন না।
যাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে জামায়াত
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জামায়াত ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, ১২–দলীয় জোট, জাকের পার্টি, লেবার পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেন।
এসব মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া একাধিক দলের নেতার সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানিয়েছেন, ইসলামপন্থীদের মধ্যে একটি ঐক্য চায় জামায়াত, বিশেষ করে নির্বাচনী ঐক্য। এ লক্ষ্যে জামায়াত ইতিমধ্যে ইসলামি দলগুলোর সঙ্গে একটা যোগাযোগের সম্পর্ক তৈরি করেছে। এর মধ্য দিয়ে কার্যত কওমি ধারার আলেমদের সঙ্গে তাদের দীর্ঘদিনের যে বিরোধ বা বিতর্ক, সেটি কমেছে। এখন নির্বাচনী ঐক্য হলে ভালো, না হলেও জামায়াত তাতে খুব সমস্যা দেখছে না। তবে জামায়াত নেতারা মনে করছেন, ইসলামি দলগুলোর মধ্যে নির্বাচনী ঐক্য হবে কি না, সেটি নির্ভর করছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলনের ওপর। জামায়াতের পর ইসলামপন্থীদের সমর্থনের দিক থেকে এই দলটিকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা হয়।
ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, ‘আমরা আগামী নির্বাচন সামনে নিয়ে দেশের ইসলামি দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক জোট না করে,বরং এর চেয়ে নির্বাচনী ঐক্য গড়ে তোলার বিষয় নিয়েই ভাবছি। এ জন্য অনানুষ্ঠানিক আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে ইসলামি দলগুলোর নির্বাচনী ঐক্য শক্তিশালী হবে না। আমরা থানা ও জেলার নেতাদের মতামত নেব। আমরা মাঠের মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাব।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্বাচন কবে হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এর মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হতে পারে। ফলে জামায়াতসহ ইসলামপন্থীদের যে নির্বাচনী ঐক্যের তৎপরতা চলছে, তা শেষ পর্যন্ত কত দূর যায়, সে বিষয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে। ইতিমধ্যে ইসলামী আন্দোলনের নেতা মুফতি ফয়জুল করিম ও খেলাফত মজলিসের নেতা মাওলানা মামুনুল হক বলেছেন, ঐক্য গড়তে তাঁদের কোনো সমস্যা নেই। তবে তার আগে জামায়াতকে ধর্মীয় কিছু বিষয়ে মাওলানা মওদুদীর লেখা নিয়ে আলেমদের সঙ্গে যে বিরোধ, তার সমাধান করতে হবে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতে ইসলামীর একজন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল প্রথম আলোকে বলেন, এই সময়ে ইসলামি দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের বিষয়ে মাঠপর্যায়ের প্রত্যাশা আছে। তবে তাঁরা মনে করেন, রাজনৈতিক জোট বা ঐক্য ঠুনকো কোনো বিষয় নয়। একটি অভীষ্ট লক্ষ্যে একাধিক পক্ষের ঐক্যবদ্ধ হওয়াটা সহজ কাজও নয়।
জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলনের বাইরে ‘সমমনা ইসলামি দলসমূহ’ নামে ছয়টি দলের একটি জোট আছে। এই জোটের শরিক দলগুলো হলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস (মামুনুল হক), মুসলীম লীগ (আবুল খায়ের), খেলাফত মজলিস (আহমদ আবদুল কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। এর মধ্যে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। আর খেলাফত আন্দোলন জোটের অবস্থানের বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। সমমনা ইসলামি দলের একজন নেতা জানান, ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে তাদের জোটে চারটি দল সক্রিয় আছে। তারা জামায়াতসহ ইসলামি দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনই দীর্ঘদিনের আত্মগোপন থেকে দৃশ্যপটে আসে জামায়াত। এরপর দলটির শীর্ষ নেতা সেনাপ্রধান, রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পৃথক বৈঠকে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন। এর ধারাবাহিকতায় অন্তর্বর্তী সরকার শপথের মাত্র ২৩ দিনের ভিতর দল নিষিদ্ধের আদেশও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। এখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় থাকা দলটির লক্ষ্য ইসলামপন্থীদের নিয়ে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচনে অংশ নেওয়া।
1 thought on “জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনী এক্যে ইসলামপন্থীদের চায়”