বিশ্বে যেভাবে পাসপোর্টের প্রচলন

বিশ্বে যেভাবে পাসপোর্টের প্রচলন হয়েছিল

তথ্যপ্রযুক্তি
Spread the love

বিদেশযাত্রার প্রসঙ্গ এলেই প্রথমেই মাথায় আসে পাসপোর্ট এর চিন্তা। ভিনদেশে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণের অন্যতম হাতিয়ার তো এই পাসপোর্টই। কিন্তু পাসপোর্টের প্রচলন কীভাবে হলো? পাসপোর্টের প্রচলন প্রথমে ১৫শ শতাব্দীতে ইউরোপে শুরু হয়েছিল। নির্বিঘ্নে ভ্রমণের জন্য এই চিঠিই পরে পাসপোর্ট হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। তবে ১৪১৪ সালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরির রাজত্ব সময় প্রচলিত পাসপোর্টের ব্যবহার শুরু হয়।

তাঁর সময়ে সংসদে পাসপোর্ট-সংক্রান্ত একটি আইনও পাস হয়। কোনো ব্যক্তি ইংরেজ কি না এ-সংক্রান্ত একটি প্রত্যয়নপত্র দেওয়া হতো রাজার পক্ষ থেকে। তবে তখনো পাসপোর্ট শব্দটির প্রবর্তন হয়নি। ১৫৪০ সালে ইংল্যান্ডে প্রিভি কাউন্সিল ব্যবসার জন্য ভ্রমণের সময় কাগজ প্রদর্শনের নিয়ম চালু করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘পাস পোর্ট’। অর্থাৎ বন্দরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার অনুমতি। কারণ সে সময় যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল জাহাজ। তাই কোনো দেশ থেকে গিয়ে নামতে হতো বন্দরে। আর মেয়াদসংবলিত পাসপোর্ট প্রচলন শুরু হয় ১৬৪১ সালে। তারপর তো নানা বিবর্তনের ধারায় এসেছে আজকের যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট। 

এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন অঞ্চল এবং দেশগুলোর মধ্যে চলাচলের অনুমতি প্রদান করা। তবে আধুনিক পাসপোর্টের ধারণা ২০শ শতাব্দীর শুরুতে আসে, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। যুদ্ধকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে যাতায়াতের নিয়মকানুন কঠোর হওয়ার কারণে, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পাসপোর্ট ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়।

বর্তমান পাসপোর্টগুলোতে সাধারণত ব্যক্তির পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য, যেমন নাম, জন্ম তারিখ, নাগরিকত্ব, এবং ছবি থাকে। এছাড়াও, এতে ভিসার স্ট্যাম্প বা নোট থাকে, যা ব্যক্তিকে বিভিন্ন দেশে প্রবেশ বা প্রস্থান করতে অনুমতি দেয়। পাসপোর্ট এখন বিশ্বব্যাপী ভ্রমণের একটি অপরিহার্য নথি হিসেবে পরিহার্য হয়।

পাসপোর্টের ব্যবহারের শুরুটা মূলত ছিল শাসকগোষ্ঠী বা রাজপরিবারের জন্য। তারা তাদের প্রজাদের একটি চিঠি বা দলিল দিয়ে পাঠাতেন, যেখানে লেখা থাকত যাত্রাপথে তাদের সুরক্ষা এবং সাহায্য করার জন্য আদেশ। এই চিঠিগুলোই আধুনিক পাসপোর্টের পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৭শ এবং ১৮শ শতাব্দীতে, ইউরোপে বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তনের কারণে ভ্রমণের নিয়মনীতি কঠোর হতে থাকে। এসময় পাসপোর্টের প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পায়, বিশেষ করে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডে।

১৯২০ সালে জাতিসংঘের পূর্বসূরী লীগ অফ নেশনসের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে পাসপোর্টের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন নিয়ে আলোচনা হয়। এতে বিভিন্ন দেশের মধ্যে পাসপোর্টের আকার, রঙ, এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর ফলে বর্তমান আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপিত হয়।

আজকের দিনে, পাসপোর্ট শুধুমাত্র ভ্রমণ ডকুমেন্ট নয়, এটি একজন ব্যক্তির নাগরিকত্ব এবং আন্তর্জাতিক পরিচয়ের প্রতীক। ডিজিটাল যুগের অগ্রগতির সাথে সাথে ই-পাসপোর্টের প্রচলনও শুরু হয়েছে, যেখানে মাইক্রোচিপের মাধ্যমে পাসপোর্টধারীর তথ্য সংরক্ষিত থাকে, যা ভ্রমণকে আরও নিরাপদ এবং সুরক্ষিত করে তুলেছে।

এখন পাসপোর্ট শুধু ভ্রমণ নথি নয়, বরং এটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, নিরাপত্তা, এবং বৈশ্বিক চলাচলের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ই-পাসপোর্ট বা বায়োমেট্রিক পাসপোর্ট হলো পাসপোর্টের একটি আধুনিক সংস্করণ, যেখানে প্রচলিত পাসপোর্টের তথ্যের পাশাপাশি একটি এমবেডেড মাইক্রোচিপে বায়োমেট্রিক তথ্য, যেমন ফিঙ্গারপ্রিন্ট, আইরিস স্ক্যান, বা মুখমণ্ডলের ছবি সংরক্ষিত থাকে। এই প্রযুক্তির ফলে পাসপোর্টধারীর পরিচয় যাচাই করা আরও সহজ এবং নির্ভুল হয়েছে।

ই-পাসপোর্ট প্রথমবারের মতো ২০০৬ সালে বিভিন্ন দেশে চালু হয়, এবং এখন এটি বিশ্বব্যাপী ব্যবহার হচ্ছে। ই-পাসপোর্টের বিশেষ সুবিধা হলো এতে ফিজিক্যাল এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে, যা পাসপোর্ট জালিয়াতি বা নকল করা খুবই কঠিন করে তুলেছে।

এছাড়াও, বিশ্বজুড়ে স্বয়ংক্রিয় বর্ডার কন্ট্রোল সিস্টেম বা ই-গেটগুলোর ব্যবহার বাড়ছে, যেখানে ই-পাসপোর্ট স্ক্যান করে দ্রুত এবং সুরক্ষিতভাবে যাত্রীদের পরিচয় নিশ্চিত করা হয়। এতে ভ্রমণের সময় আরও কমে যায় এবং যাত্রীদের অভিজ্ঞতা উন্নত হয়।

বাংলাদেশেও ই-পাসপোর্টের প্রচলন শুরু হয়েছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ সরকার ই-পাসপোর্টের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি ছিল, যা দেশের নাগরিকদের আন্তর্জাতিক ভ্রমণকে আরও সহজ এবং নিরাপদ করে তুলেছে। ই-পাসপোর্টে বাংলাদেশের নাগরিকদের তথ্য একটি চিপে সংরক্ষিত থাকে, যা বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন।

পাসপোর্ট ব্যবস্থার এই আধুনিকায়ন শুধু ভ্রমণকে সহজ করে তুলছে না, বরং এটি বিশ্বজুড়ে নিরাপত্তা এবং সুরক্ষাকে আরও উন্নত করছে। ভবিষ্যতে, আরও উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পাসপোর্ট ব্যবস্থার আরও উন্নতি হতে পারে, যা ভ্রমণের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করবে এবং বৈশ্বিক সংযোগকে আরও সুদৃঢ় করবে।

পাসপোর্ট ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ আরও উন্নত এবং প্রযুক্তি-নির্ভর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ই-পাসপোর্টের পরবর্তী ধাপ হিসেবে, ডিজিটাল আইডেন্টিটি বা মোবাইল পাসপোর্ট প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভ্রমণকারীরা তাদের পাসপোর্ট তথ্য একটি নিরাপদ মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বহন করতে পারবেন, যা তাদের ফোনে সংরক্ষিত থাকবে। এই ব্যবস্থা পাসপোর্টের ফিজিক্যাল কপি বহনের প্রয়োজন কমাবে এবং যেকোনো সময়ে, যেকোনো স্থানে সহজেই অ্যাক্সেসযোগ্য হবে।

বায়োমেট্রিক্সের আরও উন্নত ব্যবহারও পাসপোর্ট ব্যবস্থায় আসতে পারে, যেমন ডিএনএ ভিত্তিক পরিচয় যাচাই, যা পাসপোর্ট জালিয়াতির ঝুঁকি একেবারেই কমিয়ে আনবে। এছাড়া, ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি পাসপোর্ট যাচাইকরণ প্রক্রিয়াকে আরও কার্যকর এবং সুরক্ষিত করতে ব্যবহার হতে পারে।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে পাসপোর্ট তথ্যের বিনিময় সহজতর করতে একটি সমন্বিত ডাটাবেস বা ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহার করার পরিকল্পনাও রয়েছে। এটি শুধু যাত্রীদের নিরাপত্তা বাড়াবে না, বরং ভ্রমণ প্রক্রিয়াকে আরও দ্রুত এবং ঝামেলামুক্ত করবে।

এছাড়া, ক্লাউড ভিত্তিক পাসপোর্ট ব্যবস্থার সম্ভাবনাও রয়েছে, যেখানে যাত্রীদের পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য একটি কেন্দ্রীয় ডাটাবেসে সংরক্ষিত থাকবে। এটি সাইবার নিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও পাসপোর্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ এবং চলাচলের ধারাবাহিক পরিবর্তনের সাথে সাথে পাসপোর্ট ব্যবস্থাও পরিবর্তিত হচ্ছে। পাসপোর্ট কেবলমাত্র একটি ভ্রমণ নথি নয়, বরং এটি একটি গ্লোবাল আইডেন্টিটি হিসাবে বিবর্তিত হচ্ছে। নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন এই প্রক্রিয়াকে আরও সহজ, দ্রুত, এবং নিরাপদ করে তুলছে, যা আমাদের ভবিষ্যতের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে আরও উন্নত করবে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *