বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ছিল এক সময়ের প্রধান এবং একমাত্র সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল, যার প্রচার মাধ্যমের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬৪ সালে। বিটিভির অনুষ্ঠানগুলো বিভিন্ন সময়ের সাথে বদলেছে। বিটিভির অনুষ্ঠান প্রচারের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে। এখন দিনে ১৮ ঘণ্টায় প্রায় ৫০টি অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হয়। চ্যানেলটি স্যাটেলাইটের সহায়তায় দেশের প্রায় সব জায়গা থেকে নিয়মিত দেখা যায়। কিন্তু অনুষ্ঠানের সেই পুরনো মান না থাকার কারণে আগের সেই জনপ্রিয়তা নেই রাষ্ট্রায়িত চ্যানেলটির। দেশে যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে,তখন সেই সরকারের অধীনে সরকারের গুনকীর্তন ও তাদের পক্ষে প্রচারে ব্যস্ত থাকে। চ্যানেলটির প্রসঙ্গ উঠলে অনেকে এখন ঠাট্টা করে বলেন, ‘বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন’।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বিটিভি কতটা পরিবর্তিত হয়েছে, তা খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, বর্তমান সরকারের দিক থেকে বাধ্যবাধকতা না থাকলেও দীর্ঘদিনের অভ্যাস থেকে বিটিভি বের হতে পারছে না। ফলে অনুষ্ঠান ও সংবাদ সম্প্রচারে এখনো দেখা যাচ্ছে পুরোনো সেই সরকার তোষণনীতি। ঘটনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন ব্যক্তি। কর্তৃপক্ষ বলছে, পরিবর্তনের জন্য সময় লাগবে।
জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের তালিকায় যত আয়োজন
বিটিভির অনুষ্ঠান বর্তমানে দেখা যায় তাদের ভেরিফাইড ফেসবুক ও ইউটিউব পেজেও। যার কারণে দর্শক টেলিভিশন সেটের সামনে না বসেও দেখতে পারেন পছন্দের অনুষ্ঠান। তবে বিটিভির ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেজে বিটিভির দর্শক কম। গত ২৪ সেপ্টেম্বর সারা দিনের অনুষ্ঠান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সংবাদ ও অধিকাংশ অনুষ্ঠানের দর্শকসংখ্যা হাজারের কম। সে তুলনায় আগে প্রচারিত বিতর্ক প্রতিযোগিতা এবং টক শোর দর্শকসংখ্যা ভালো। তা বাড়তির দিকেও। বিটিভির ওয়েবসাইটে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের তালিকায় ছয়টি আয়োজনের নাম ও ছবি সংযুক্ত করা হয়েছে। সেগুলো হলো ‘গান চিরদিন’, ‘যাত্রা’, ‘অনেক কথা বলার ছিল’, ‘পরিবর্তন’, ‘তারকা কথন’ ও ‘রূপালি ঢেউ’।
কোনো কোনো অনুষ্ঠানের অবস্থা আরও সঙিন। যেমন ২৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘কেমন আছে অর্থনীতি’র দ্বিতীয় পর্ব ২০ ঘণ্টায় দেখেছেন মাত্র ১৭৪ জন। ‘ব্যাংকিং খাত সংস্কার, অর্থ পাচার রোধ এবং কর সংস্কারসহ উদ্বেগের মূল ক্ষেত্রগুলোতে সহযোগিতা দেবে (আইএমএফ)’ সংবাদ ক্লিপটি ২১ ঘণ্টায় ইউটিউবে দেখেছেন ৫৯ দর্শক। এ তুলনায় নির্দিষ্ট কয়েকটি নাটকের দর্শক কিছু বেশি।
একসময় বিটিভিতে ইংরেজিসহ বিভিন্ন দেশের জনপ্রিয় ড্রামা বাংলায় ডাবিং (ভাষান্তর) করে সম্প্রচার করা হতো। ‘টারজান’, ‘ম্যাকগাইভার’, ‘এক্স ফাইলস’, ‘ডার্ক জাস্টিস’, ‘রোবোকপ’-এর মতো ড্রামাগুলোর ভক্ত ছিল সব বয়সী দর্শক। সেসব আর এখন প্রচার হয় না।
বিটিভির অনুষ্ঠান সম্প্রচার শুরু হয় সকাল ৭টায়, শেষ হয় রাত সাড়ে ১২টার কাছাকাছি। দিনে ৯টি সংবাদ বুলেটিনসহ প্রতিদিন গড়ে ৪৮ থেকে ৫২টি অনুষ্ঠান সম্প্রচার হয়। এর মধ্যে ৮ থেকে ১০টি ‘ফিলার’ প্রচারিত হয়, যার অধিকাংশ থাকে সরকারের কার্যক্রম, জনসচেতনতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে। বিভিন্ন কর্মসূচি ও দিবস সম্পর্কেও নির্মিত হয় এসব ফিলার।
১১ সেপ্টেম্বর সম্প্রচার করা অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে আছে ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’, ‘সমাজদর্পণ’, ‘নজরুল সংগীতের অনুষ্ঠান’, ‘নিসর্গ ও নক্ষত্র’, সচেতনতামূলক নাটক ইত্যাদি। অনুষ্ঠানগুলোর জন্য কত দর্শক অপেক্ষা করেন সেটির একটি উদাহরণ পাওয়া যাবে ইউটিউবে দর্শক উপস্থিতি ও তাঁদের সম্পৃক্ততা দেখে। ১১ সেপ্টেম্বরের পর থেকে আর দৈনিক অনুষ্ঠানসূচির তালিকা প্রকাশ করেনি প্রতিষ্ঠানটি। বিটিভির অনুষ্ঠানে দৃশ্যমান পরিবর্তনের মধ্যে বড় দুটি পরিবর্তন টক শো আর ‘ফ্যাসিবাদের দিনলিপি’ আয়োজন।
৭ সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে ‘আগামীর বাংলাদেশ’ নামে নতুন টক শো। বিটিভির মুখ্য বার্তা সম্পাদক মুন্সী মো. ফরিদুজ্জামান বলেন, ‘এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর এখন সরকার থেকে কোনো চাপ নেই বিটিভির সংবাদ সম্প্রচারের কনটেন্ট নিয়ে। তবে দীর্ঘদিনের একটি কাঠামোয় পরিবর্তন আনতে সময়ের প্রয়োজন। এ ছাড়া আছে কিছু অদক্ষ জনবল ও প্রযুক্তিগত দুর্বলতাও।’ এসব বিষয় জানিয়ে জানতে চাওয়া হয় বিটিভির নবনিযুক্ত মহাপরিচালক মো. মাহাবুবুল আলমের কাছে। তিনি বলেন, ‘কারও যদি পারফরম্যান্স (দক্ষতা) ভালো না হয়, তাহলে সময়ের সঙ্গে এমনিতেই ঝরে পড়বে। আমি মাত্র যোগ দিয়েছি। বিটিভির সম্প্রচার নীতিমালা পুনর্বিবেচনা করা হবে।’
শুধু জনপ্রিয় অনুষ্ঠান সম্প্রচারই বিটিভির লক্ষ্য নয়, জনগণের রুচি তৈরি করাও এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব। এই নীতি থেকে বিটিভি সরে গেছে। আবার এখানে ফিরে আসতে হবে বলেও মন্তব্য করেন মো. মাহাবুবুল আলম।
সংবাদে এখনো পিছিয়ে
২৪ সেপ্টেম্বর বেলা দুইটার সংবাদের তৃতীয় শিরোনাম ছিল, ‘শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে পূর্বাচলে ৬০ কাঠা প্লট বরাদ্দে অনিয়ম, তদন্তের দাবি বিশিষ্টজনদের।’ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের প্রধান বুলেটিনে বিশেষ সংবাদ হিসেবে প্রচারিত প্রতিবেদনটি দুই সপ্তাহ আগে ১০ সেপ্টেম্বর দেশের অন্যান্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় এই প্রচার যন্ত্রের সময়ের সঙ্গে চলতে না পারার উদাহরণ বেশ পুরোনো।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পূর্বে বেলা দুইটা ও রাত সাড়ে ১১টার সংবাদ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, শুধুই সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচি ও উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সংবাদ থাকত ৩০ মিনিটের মধ্যে প্রথম ১৫ মিনিট। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের খবর দিয়েই সংবাদ বুলেটিনের গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পর্বটি পূর্ণ হতো। তাছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো বুলেটিনেই তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে তৈরি বিশেষ প্রতিবেদন দেখা যায় না।
মুখ বদলাচ্ছে অনুষ্ঠানে
বাংলাদেশের জাতীয় টিভির একজন নাম প্রকাশে অনচ্ছুক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী এখন থেকে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে হবে। কোনো ব্যক্তিকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে তাঁর কাজের মান বুঝে সংবাদ প্রচার করতে।’
৭ সেপ্টেম্বর শুরু হওয়া টক শো ‘আগামীর বাংলাদেশ’ সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক সরদার ফরিদ আহমদ। আগে অন্যান্য গণমাধ্যমে উপস্থাপনা করলেও বিটিভিতে তিনি প্রথমবারের মতো উপস্থাপনা করছেন। এই টক শোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, এখন যৌক্তিক আলোচনায় সরকারের সমালোচনা হলেও তাতে বিধিনিষেধ নেই।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান গত ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে ‘আগামীর বাংলাদেশ’ টক শোতে অতিথি ছিলেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিটিভিতে বসে মনে হয়নি, সেন্সর করে কথা বলতে হবে।
আরও পড়ুন মীনা, রাজু, মিঠুরা কে কোথায়
2 thoughts on “বিটিভির অতীত ও বর্তমান অনুষ্ঠান কেমন”