‘সবার জন্য শিক্ষা’ কি প্রচলিত বাক্য ?

‘সবার জন্য শিক্ষা’ শুধুই কি প্রচলিত বাক্য ?

শিক্ষা
Spread the love

মাত্র ১৩ বছর বয়সী একটি মেয়েশিশু। সামনের চারটি দাঁত ভেঙে গেছে। হাত ও শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছ্যাঁকার ক্ষত। কোনো কোনো ক্ষত দগদগে ঘায়ের রূপ নিয়েছে। বুক, পিঠসহ সারা শরীরে নতুন-পুরোনো মারের চিহ্ন। ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এই শ্লোগান কি এই মেয়েদের মত যারা আছে তাদের ক্ষেত্রে কি প্রযোজ্য হবে? 

অতি সম্প্রতি  রাজধানীর একটি অভিজ্যত আবাসিক এলাকায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত মেয়েটি। তার শরীরের করুণ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েটিকে হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়েছে। যা সত্যিই সবাইকে চমকে দেওয়ার মতো খবর। কিন্তু ইট-পাথরের এই নগরের মানুষদের এ ধরনের সংবাদ এখন আর চমকে দেয় না।

হতদরিদ্র শিশুরা-সন্তানেরা ধনীদের বাসাবাড়িতে কাজ করবে, কারণে-অকারণে মার খাবে, মা-বাবার সঙ্গে দেখাও করতে দেওয়া হবে না—এসব বিষয় হয়তো স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়েছে দেশের মানুষ। তা নাহলে এই রকম ঘটনা প্রায় নিয়মিতভাবেই ঘটতে থাকবে কেন। কিংবা কেনই–বা এসব ঘটনার প্রতিবাদ, প্রতিকার হয় না। যে ঘটনায় আমাদের ফুঁসে ওঠার কথা, ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানোর কথা, সে ঘটনায় আমরা নীরব, নির্বিকার। আমরা ধরেই নিয়েছি, গরিবঘরের শিশুদের এটাই নিয়তি। যে বয়সে তাদের স্কুলে থাকার কথা, সে বয়সে তারা ঘরে-বাইরে শারীরিক শ্রমের কাজ করছে, নির্যাতিত হচ্ছে।

২০১০ সালের সর্বশেষ জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, ‘একটা জাতির উন্নতির চাবিকাঠি হলো শিক্ষা। দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য পূরণে শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান অবলম্বন।’ এই শিক্ষানীতি যাঁরা প্রণয়ন করেছেন, তাঁরা উপলব্ধি করেছেন দেশের সব শিশুর শিক্ষার অধিকার রয়েছে। শিক্ষার উদ্দেশ্য কী, কোন কৌশলে তা বাস্তবায়িত হতে পারে—এগুলো নিয়েও কথা আছে শিক্ষানীতিতে। কিন্তু যে শিক্ষা দারিদ্র্যকে দূর করবে, সেই দারিদ্র্যকে পাশ কাটিয়ে স্কুল-উপযোগী শিশুকে কীভাবে বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া যায়, তার কোনো দিকনির্দেশনা সেখানে নেই। দরিদ্রঘরের শিশুকে বিদ্যালয়ে আনার ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের মধ্যেও ফাঁক দেখা যায়।

এখনো দেশের বিপুলসংখ্যক শিশু শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এর একটি বড় অংশ কর্মজীবী শিশু। কাজে থাকা শিশুদের মধ্যে মেয়েশিশুরা সাধারণত বাসাবাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে নিযুক্ত হয়। আর ছেলেশিশুরা বিভিন্ন কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত থাকে। এর বাইরেও আছে পথশিশু এবং পিতামাতা বা অভিভাবকহীন শিশু। এ ছাড়া শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী, পাহাড়ি বা দুর্গম অঞ্চলে থাকা, পাচার থেকে উদ্ধারকৃত এবং আইনের সংস্পর্শে আসা শিশুদের আরেকটি অংশ শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। কোন ধরনের কতসংখ্যক শিশু শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে আছে, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

সরকারের তরফ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রচার করা হয়েছে, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তির উপযোগী দেশের প্রায় শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তির লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। তবে বাস্তবতা এই কথা বলে না। তা ছাড়া সরকারি হিসাবেই ভর্তি হওয়া শিশুদের ২০ ভাগের বেশি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই বিদ্যালয় ত্যাগ করে। এর প্রধান কারণ দারিদ্র্য। অর্থকষ্টে থাকা অভিভাবকেরা মনে করেন, পড়াশোনা করে আদৌ কিছু হয় না। অথচ একসময় ‘পড়াশোনা করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’—এ রকম একটি কথা তাঁদের বিশ্বাসে ছিল। দরিদ্র পরিবারগুলো কষ্ট করে হলেও সন্তানের লেখাপড়া নিশ্চিত করার চেষ্টা করত। এখন তারাও বুঝতে পারে, উচ্চশিক্ষার ফলাফল ‘বেকারত্ব’।

দারিদ্র্যকে বিবেচনায় নিয়ে শিশুর শিক্ষাগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকার যেসব প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তার মধ্যে উপবৃত্তি একটি। সরকারি হিসাবে, প্রাথমিক স্তরে উপবৃত্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি। এর মধ্যে প্রাক্-প্রাথমিকের প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে মাসে ৭৫ টাকা এবং প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থীকে মাসে ১৫০ টাকা করে বৃত্তি দেওয়া হয়। এরপরও শিক্ষার্থী কেন ঝরে পড়ে, সেটি না বোঝার কোনো কারণ নেই। এই টাকা শিক্ষার্থীকে কোনো ধরনের আর্থিক সুরক্ষা দিতে পারে না। বিন্যা মূল্যে শিক্ষার্থীকে পাঠ্যবই দেওয়া হচ্ছে বটে, কিন্তু একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষা খরচ মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। অতিদরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে তা সামাল দেওয়া অসম্ভবপ্রায়।

‘স্কুল ফিডিং’ কার্যক্রমের আওতায় দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার ৯৩টি উপজেলার ১৫ হাজার ৭০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে ৭৫ গ্রাম ওজনের বিস্কুট সরবরাহ করা হয়। তার পরিমাণ এতোই কম যে ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দেয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও  শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমও ঠিক পরিষ্কার নয়।

বিভিন্ন এনজিও ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ভূমিকা প্রায়ই ক্ষেত্রে নিরীক্ষামূলক। সব দিক দিয়ে রাষ্ট্রের ভূমিকা দেখে স্রেফ হতাশ হতে হয়। ‘উন্নয়নে’র ফিরিস্তি তৈরি ও তার প্রচারণার জন্য সরকার নানা সময়ে চটকদার কিছু উদ্যোগ নেয়। বাস্তবে দরিদ্র শিশুদের শিক্ষা নিয়মিত ও নিশ্চিত করার জন্য এসব উদ্যোগ বিশেষ প্রভাব ফেলে না।

অতীতে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের বাংলা বইয়ের একটি ছড়া নিয়ে সুশীল মহলে আপত্তি উঠেছিল। ‘রাখাল গরুর পাল লয়ে যায় মাঠে,/ শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে ছড়াটিতে এমন দুটি লাইন ছিল:।’ আপত্তি তুলেছিল, রাখালেরও কি শিক্ষার অধিকার নেই? সে কেন সাতসকালে গরুর পাল নিয়ে মাঠে যাবে। আগে গ্রামগুলোতে সাধারণত কিশোর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী ছেলেরা গরু রাখার ও গৃহকর্মের দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁরা ‘রাখাল’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই রাখালদেরও জন্ম দরিদ্রঘরে, তবে তাঁরা শিশু নন। তবু ‘সবার জন্য শিক্ষা’র অধিকারকে স্বীকার করে পাঠ্যবই থেকে ছড়াটি সরিয়ে নেওয়া হয়।

শিশুশ্রম নিষিদ্ধ আন্তর্জাতিকভাবেও এবং শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত। শিশুকে  শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, শ্রমে নিযুক্ত করার পেছনে রাষ্ট্র দায় এড়াতে পারে না। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হয়ে শারীরিকভাবে বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ার এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্যাতিত হওয়ার ব্যাপার ঘটছে শিশুদের। দরিদ্র মা-বাবা একরকম বাধ্য হয়েই তাঁদের আদরের সন্তানকে কাজে নিয়োগ করেন। এর মানে এই নয়, সন্তানকে তাঁরা ‘বিক্রি’ করে দেন। তার জন্য আনন্দময় বিদ্যালয়ের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আরও পড়ুন  বিটিভির অতীত ও বর্তমান অনুষ্ঠান কেমন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *