ভয়ংকর আয়নাঘর

ভয়ংকর আয়নাঘর: গোপন বন্দীশালা

বাংলাদেশ
Spread the love

২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে, বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম হয়ে উঠেছে সরকারি নিপীড়নের একটি নিষ্ঠুর ও কার্যকর পন্থা। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৬০৫ জন ব্যক্তি বাংলাদেশে গুমের শিকার হয়েছেন।  যাদের অনেকের দুরভাগ্যে ভয়ংকর আয়নাঘর এর গোপন বন্দীশালা  শাস্তির মুখে। সন্ত্রাসবাদ ও অপরাধকর্মে জড়িত থাকার সন্দেহে আটক ব্যক্তি যেমন রয়েছেন, তেমনি রয়েছেন রাজনৈতিক ভিন্নামতালম্বী, শাসক দলের সমালোচক ।

Table of Contents

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সম্প্রতি ৮৬ জন ব্যক্তির তথ্য  প্রকাশ করেছে, যাদেরকে অন্তত ১০ বছর ধরে বন্দী রাখা হয়েছে ও যাদের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। এই ব্যক্তিরা গোপন বন্দীশালায় আটক রয়েছেন অথবা হত্যার শিকার হয়েছেন বলে সংগঠনটি ধারণা করছে। এই কারাগারটির তিনজন সাবেক বন্দী — যাদের মধ্যে একজন সাবেক সামরিক কর্মকর্তাও রয়েছেন — প্রকাশ্যে এই গোপন বন্দীশালার বর্ণনা দিয়েছেন।

আয়নাঘরে মাইকেল চাকমা

ঢাকার শ্যামলি থেকে সাদা পোশাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ২০১৯ সালের ৯ই এপ্রিল থেকে নিখোঁজ ছিলেন বাংলাদেকথিত ‘আয়নাঘরে’ বন্দি থাকার পর ছয় আগস্ট তাকে চট্টগ্রামের একটি সড়কের ধারে চোখ বেঁধে ছেড়ে দেয়া হয়।বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ-এর সংগঠক মাইকেল চাকমা। পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাকে গোপন বন্দীশালায় আটকে রাখা হয়েছিল, যেটি ‘আয়নাঘর’ নামে অনেকের কাছে পরিচিত। ছেড়ে দেয়ার আগে চোখ বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার রাতটিকে জীবনের অন্তিম সময় হিসেবেই ভেবে নিয়েছিলেন মাইকেল চাকমা।

শেষ রাতে তাকে গাড়িতে নেয়ার সময় কিছুটা আলগা করে চোখে কাপড় বাঁধা ছিল, যেটি এক পর্যায়ে গাড়ির সিটে ঘসে ঘসে কিছুটা নামাতে সক্ষম হন এবং আজানের পর কিছুটা আলোর দেখা পান। ২০১৯ সালের পর ৬ই আগস্ট ২০২৪ সালে প্রথম দিনের আলোর দেখা পান মাইকেল চাকমা। তবে তাকে যে এদিন ছেড়ে দেয়া হবে সেটি কল্পনাও করেননি।

রাষ্ট্রীয় বাহিনী জড়িত ছিল বলেই তার অভিযোগ এবং তিনি বলেন,পাঁচ বছর ফিরে এসে মাইকেল চাকমা বলছেন, তার জীবনের এই প্রায় শেষ করে দিয়েছে তাদের বিচার করতে হবে।কিছুটা সুস্থ্ ও স্বাভাবিক হলে আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পাশাপাশি সরকারের কাছে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দাবি করবেন বলেও মাইকেল চাকমা।অত্যন্ত অমানবিক যেভাবে তারা রাখে এটাতো। মানুষের বসবাসের জায়গা না এইটা। এটাতো কবরের মতো।

মাইকেল যে বন্দিদের দেখেছেন,গত পাঁচ বছরের বেশি সময়ে তার সঙ্গে রাখা হয়েছে আরো দুজনকে এছাড়া অদেখা দুজনের নাম তিনি শুনতে পেয়েছেন। তবে এইসব বন্দির ভাগ্যে কী ঘটেছে সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই মাইকেল চাকমার। তিনি ৪ থেকে ৫ জন বন্দীদের দেখেছে। কথা বলার সুযোগ বা কেউ কাউকে দেখার ছিল না গোপন কারাগারে। 

মাইকেল চাকমার সঙ্গে দুই দফায় দুজন বন্দিকে একসঙ্গে রাখা হয়েছিল। তাদের পরিচয় জানতে পারেন মাইকেল অত্যন্ত গোপনে কথা বলে। একসাথে যাদের সঙ্গে ছিলেন তার মধ্যে একজনের নাম  এরশাদ আরেকজনসাইদুল  ।

আয়নাঘরে সেলিম

২০১৬ সালের ২৯ মে। তার আটকের ঘটনাটি ঘটেছিলো ভুল পরিচয়ের কারণে।
সেলিমের গ্রামের বাড়ি কাপাসিয়ায়। তার পারিবারিক গাড়ির ব্যবসা আছে। কয়েক বছর আগে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার আগে তিনি নিজেও ঢাকা ও গাজীপুর সড়কে বাণিজ্যিক গাড়ি চালিয়েছেন হাজারবার। ফলে তাকে বহনকারী মাইক্রোবাস যখন রাজেন্দ্রপুর রেলক্রসিংয়ে পৌঁছালো অথবা রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টমেন্টের ভেতর সেনা চৌকি পার হলো, তখন তার চোখ বাঁধা থাকলেও তিনি বুঝতে পারছিলেন এই সড়কটি (রাজেন্দ্রপুর-গাজিপুর-ঢাকা) কোথায়। তাকে ঠিক কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সেটাও তিনি মোটামুটি ধারণা করতে পারছিলেন।


যখন তাকে অবশেষে মাইক্রোবাস থেকে বের করা হলো, তখন তিনি কলাপসিবল গেট — যাকে বাংলাদেশে অনেকে “কেঁচি গেট” বলে থাকেন — খোলার শব্দ শুনলেন। তারপর তাকে একটি সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে জানালাবিহীন একটি কক্ষে নেয়া হলো। একজন ডাক্তার এসে তার রক্তচাপ পরীক্ষা করলেন ও মেডিক্যাল চেকআপ করলেন। তারপর তাকে একটি সেলে নেয়া হলো।

তাকে কী ধরণের জলখাবার দেয়া হতো বা কোন ব্র্যান্ডের পানির বোতল দেয়া হতো, ইত্যাদি। তাকে যেই স্থানে রাখা হয়েছিল সেখানে প্রায় সারা দিন-রাত কয়েকটি অত্যন্ত উচ্চশব্দের এগজস্ট ফ্যান চলতো। তিনি মাঝে মাঝে একটি বিমানের উঠা-নামার কম্পন অনুভব করতেন- ফলে তিনি অনুমান করতে পেরেছেন যে পাশেই হয়তো কোন বিমানবন্দর বা ঘাঁটিতে বিমান উঠানামা করে। সেলিমের আগে ওই কক্ষে যারা বন্দী ছিলেন, তারাও তার অপহরণকারীদের পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্ট সূত্র রেখে গেছেন — অনেকেই খাবারের সাথে দেয়া মাংসের হাড় বা কোন শক্ত বস্তু দিয়ে ডিজিএফআইয়ের নাম কক্ষের দেয়ালে খোদাই করে লিখে গেছেন।

আয়নাঘরে হাসিনুর রহমান

হাসিনুর রহমান কে  আটক করা হয় ২০১৮ সালের ৮ আগস্ট। হাসিনুর প্রায় ১৮ মাস “নিখোঁজ” ছিলেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক এই লেফটেন্যান্ট কর্নেল শুরু থেকেই নিজের “হাই ভ্যালু” বন্দী হওয়ার বিষয়টি বুঝতেন। প্রথমবার গুমের শিকার হয়েছিলেন ২০১১ সালের জুলাইয়ে। সামরিক বাহিনীতে তিনি পদকপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন; বীরত্বের জন্য পেয়েছিলেন “বীর প্রতীক” খেতাব। র‍্যাবের একটি ইউনিটের অধিনায়ক থাকাকালে তিনি বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ২০১২ সালে ২৮ বছর চাকরি শেষে তাকে বরখাস্ত করা হয়। অভিযোগ হলো, তিনি নিজেই জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন! এই অভিযোগ তিনি দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করেছেন।

 

মিরপুর ডিওএইচএস-এ নিজের বাসা থেকে তাকে যারা ২০১৮ সালে ধরে নিয়ে যায়, তাদের পরনে ছিল পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা ডিবির পোশাক (কাউকে আটক করার কোনো আইনি এখতিয়ার ডিজিএফআই-এর নেই; ফলে, কাউকে অপহরণ করতে হলে এই সংস্থার সদস্যরা বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় ধারণ করে)।

সেলিম তার গুমের বিষয়ে কিছুই না জানলেও, হাসিনুর ছিলেন সামরিক বাহিনীর ভেতরকার একজন লোক। তিনি এই গোপন বন্দীশালার অবস্থান সম্পর্কে স্পষ্ট ও নিখুঁত বর্ণনা দিয়ে বলতে পেরেছেন। তিনি বলেন, “দক্ষিণে মেস বি,উত্তরে ১৪ তলা বিল্ডিং, তার মাঝখানে হলো একটা মাঠ, মাঠের মাঝখানে   এই বন্দিশালা । ডিজিএফআইয়ের এমটি শেড, এবং উত্তর-পূর্ব কোনে হলো ডিজিএফআইয়ের মসজিদ। এই গুম হাউজটার ছদ্মনাম হলো আয়নাঘর।”

হাসিনুর রহমানের দেয়া এসব তথ্যের ভিত্তিতেই কারাগারটির অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। গুগল আর্থের স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত সাম্প্রতিক ছবি অনুযায়ী ওই ভবনটির ছাদ তারপুলিন বা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা। হাসিনুর নিজেও সম্প্রতি পাশের একটি ভবনে গিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন যে ভবনটি আসলেই ছাউনি দিয়ে ঢাকা ছিল।

ভুয়া অভিযোগ

শেখ মোহাম্মদ সেলিমকেও ২০১৬ সালের আগস্টে আদালতে উপস্থাপন করা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি বাংলাদেশের একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠনের সদস্য ছিলেন।তো পরে ওনারা আমার বয়সটা নিয়ে — মানে আমার নাম জিজ্ঞেস করলও,  আমি বললাম শেখ মোহাম্মদ সেলিম, তো আমার পিতার নাম?ওনারা মানতে চাচ্ছিলনা যে আমার জন্ম তারিখ এক-এক উনিশো নব্বই, তো ওনারা  তো ওইটা অনেকবার আমাকে জিজ্ঞেস করলো।”

 

ওইসময়ই মাইর শুরু করে, আপনার মানে কোন দিক থেকে বারি দেয় আমি অনুভব করতে পারি নাই বাট ডানে বামে, মানে আমি এই দিগে কাইত হইলে ওইদিগে বাড়ি দেয়, পায়ে বারি দেয় ডান পাশে বাম পাশে খুব জোরে জোরে মারে, তো আমিও খুব কান্নাকাটি করি। সব বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তো একটি চুপ করে রইলো ওনারা।

ওই মহিলা হঠাত করে জিজ্ঞেস করলো, শেখ মোহাম্মদ সেলিম, আপনি কখনও পঞ্চগড় গেছেন? আমি বললাম যে, না।  তারপরে জিজ্ঞেস করলো যে, আমাকে সম্ভবত আপনার গোপালগঞ্জের যে কোন একটা এরিয়ার নাম বলল, যে আপনি গোপালগঞ্জ সম্ভবত কি জানি কোটোআলীপাড়া হয়তোবা মেবি এইরকমই কোন একটা নাম হতে পারে। যে ওইখানে আমি নাকি বোমা পুঁতে রাখছিলাম শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য। আমি বলছি যে না, আমি ওই এলাকাতে কখোনো যাই নাই। তো ওনারা কেমন জানি মানতে ছিলোনা যে আমি আমার বাড়িটা কাপাসিয়া ৬ নং ওয়ার্ড।”

ডিজিএফআই সম্ভবত এমন এক ব্যক্তির বিষয়ে আগ্রহী ছিল, যিনি “সেলিম” ছদ্মনামটি ব্যবহার করতেন, যিনি কিনা কোটালিপাড়ায় (কোটোআলীপাড়া নয়, যেমনটা সেলিম ভেবেছিলেন) শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে বোমা পুঁতে রাখার দায়ে অভিযুক্ত।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে র‍্যাব ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যাক্তিকে আটক করে। তখন র‍্যাবের সূত্রে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয় যে, ইকবাল হোসেন হরকাতুল জিহাদ নামে একটি নিষিদ্ধ জিহাদি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মামলায় সন্দেহভাজন। সংবাদে আরও বলা হয় যে, ইকবাল হোসেন এতদিন মালয়েশিয়ায় লুকিয়ে ছিলেন এবং “সেলিম” ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন। তাকে ধরার জন্য সাভার ও গাজীপুরে একাধিক অভিযান পরিচালনার কথাও বলা হয়। এই সব কিছুই শেখ মোহাম্মদ সেলিমের পরিচিতির সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু ডিজিএফআই যখন বুঝতে পারলো যে তারা ভুল সেলিমকে ধরে এনেছে, তারা তাকে ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ডিবি পুলিশ তাকে ভুয়া মামলায় আদালতে পাঠিয়ে দেয়।

প্রতিক্রিয়া

কথা বলেছেন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক মীনাক্ষী গাঙ্গুলি, “গুম নিয়ে আমাদের কাজের সূত্রে আমরা অবশ্যই জানতাম যে গোপন বন্দীশালা রয়েছে। তারপরও এটি ভীষণ হতাশাজনক যে এগুলোর অস্তিত্ব আসলেই  আছে — তাও আবার একটি সামরিক স্থাপনার অভ্যন্তরে এবং সামরিক বাহিনী যা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে অবগত।

আমরা আশা করি, এখন অত্যন্ত দ্রুতগতিতে একটি তদন্ত হবে, কেবল এই বন্দীশালা নিয়ে নয়, অন্যগুলো নিয়েও। যেসব মানুষকে এখানে রাখা হয়েছে — যাদের অনেককে বছরের পর বছর ধরে বন্দী রাখা হয়েছে, আর যাদের পরিবার এখনও তাদের ফেরার অপেক্ষায় আছে — সেই ব্যাক্তিদের অনতিবিলম্বে মুক্তি দেয়া উচিত। এরপর তাদের এভাবে গোপনে আটক রাখার জন্য কারা দায়ী, তা খুঁজে বের করতে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া উচিত।”

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *