বাংলাদেশ ৪ ফিফটিতে ৩২১ রান করেছিল । যা এই বছরে ওয়ানডে তো বটেই, ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতেও বাংলাদেশের দলীয় সর্বোচ্চ। কিন্ত ৪ উইকেটে পরাজিত হয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ধবলধোলাই এর শিকার হয় টাইগাররা।
তবে মাহমুদউল্লাহর ইনিংসটির কথা আলাদা করে বলতেই হয়। খুব সম্ভবত ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাটিতে ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলতে নেমেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। বাংলাদেশের এই দলটার সবচেয়ে অভিজ্ঞ ক্রিকেটার ৬৩ বলে উপহার দিয়েছেন অপরাজিত ৮৪ রান।
শুধু সেন্ট কিটসের ওয়ার্নার পার্কের প্রসঙ্গ আনলে রান তোলায় মাহমুদউল্লাহর ধারেকাছেও কেউ নেই। এ মাঠে ওয়ানডেতে তিনি করেছেন ৩৪১ রান; ব্যাটিং গড় ১৭০.৫০। ৬ ইনিংসে ৫টিতেই ফিফটি, অপরাজিত ৪ বার! কিন্তু ম্যাচ শেষে সেই মাহমুদউল্লাহকে মাঠ ছাড়তে হলো মলিন মুখে। তাঁকে ম্লান করে সেন্ট কিটসের ২২ গজে ব্যাট হাতে যে শাসন (বাংলাদেশের বোলারদের জন্য শোষণ) করেছেন আরেকজন—আমির জাঙ্গু। বাঁহাতি এই ব্যাটসম্যান অভিষেকেই ঝোড়ো সেঞ্চুরি করে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এনে দিয়েছেন স্মরণীয় এক জয়।
ক্যারিবীয়রা জাঙ্গুর অপরাজিত ৮৩ বলে ১০৪ রানের সঙ্গে কিসি কার্টির ৯৫ রানের সুবাদে বাংলাদেশের দেওয়া ৩২২ রানের লক্ষ্য ২৫ বল এবং ৪ উইকেট হাতে রেখে টপকে গেছে, যা এই মাঠে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রান সফলভাবে তাড়া করার রেকর্ড। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডেতে কোনো দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়।
এই জয়ে ১০ বছর পর বাংলাদেশকে ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই করল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। সর্বশেষ ২০১৪ সালে মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বাধীন দল ক্যারিবীয়দের কাছে ৩–০ ব্যবধানে ওয়ানডে সিরিজ হেরেছিল। সেই সিরিজও হয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ কোনো ওয়ানডে সিরিজে ধবলধোলাই হলো ৩ বছর ৯ মাস পর। এর আগে ২০২১ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ড সফরে ৩–০ ব্যবধানে হেরেছিল তামিম ইকবালের নেতৃত্বাধীন দল।
এক ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজের ফয়সালা হয়ে যাওয়ায় এ ম্যাচে দুই দলই কিছু পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশের টিম ম্যানেজমেন্ট তিন পেসার তানজিম হাসান, শরীফুল ইসলাম ও নাসুম আহমেদকে বসিয়ে খেলিয়েছে হাসান মাহমুদ, তাসকিন আহমেদ ও নাসুম আহমেদকে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাদের দলে এনেছে একাদশে চার পরিবর্তন। অভিষেক হয়েছে দুজনের—ম্যাচের নায়ক আমির জাঙ্গুর সঙ্গে পেসার জেডিয়াহ ব্লেডস।
সফরকারীদের শুরুটা যে রকম বাজে হয়েছিল, তাতে স্বাগতিকদের কেউ একজন দেদারসে রান না বিলালে এত বেশি হয়তো সম্ভব হতো না।
টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে পাঠিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক শাই হোপ। তাঁর সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করতে খুব বেশি সময় নেননি একাদশে ফেরা আলজারি জোসেফ। নিজের দ্বিতীয় ওভারেই তানজিদ হাসান ও এক বলের ব্যবধানে লিটন দাসকে শিকার করেন । ‘ডাক’ মেরেছেন দুজনেই ।
ছন্দে থাকলে লিটন দাসের ব্যাটিং দেখা ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য চোখের শান্তি। কিন্তু ছন্দে না থাকলে তাঁর আউট হওয়ার দৃশ্যের চেয়ে দৃষ্টিকটু বিষয় বোধহয় ক্রিকেটে খুব কমই আছে। এ ম্যাচেও সেরকম কিছুই হয়েছে।
ম্যাচের প্রথম ওভারেই স্লিপে ব্র্যান্ডন কিং সৌম্য সরকারের ক্যাচ না ছাড়লে বাংলাদেশের প্রথম তিন ব্যাটসম্যানই ০ রানে ফিরতেন। দুইয়ের জায়গায় তিন উইকেট হয়ে যেত জোসেফের।
সুযোগটা কাজে লাগিয়ে তৃতীয় উইকেটে অধিনায়ক মিরাজের সঙ্গে ১৩৬ রানের জুটি গড়েন সৌম্য। এতেই বড় সংগ্রহের দিকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। এক পর্যায়ে মনে হচ্ছিল, আজ বুঝি সৌম্য–মিরাজ দুজনই সেঞ্চুরি পেয়ে যাবেন। ঠিক এমন সময় মোতির বলে এলবিডব্লুর ফাঁদে পড়েন সৌম্য।
এরপর বেশিক্ষণ টিকতে পারেননিও মিরাজ। খামোখা ক্রিজ ছেড়ে বেরোলে রাদারফোর্ডের সরাসরি থ্রোতে রানআউট হন বাংলাদেশ অধিনায়ক। আফিফ হোসেনও হতাশ করেছেন। ১৫ রান করতে গিলেছেন ২৯ বল।
এরপরই জাকের আলীকে নিয়ে মাহমুদউল্লাহর ১৫০ রানের মহাকাব্যিক জুটি, যা ওয়ানডেতে ষষ্ঠ উইকেটে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ। আগের সর্বোচ্চতেও ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। ২০১৮ এশিয়া কাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তাঁর সঙ্গে ১২৮ রানের জুটি গড়েছিলেন ইমরুল কায়েস।
শেষ ৪ ওভারে ৫৯ রান তুলেছে বাংলাদেশ। ৬২ রানে অপরাজিত থাকা জাকের পেয়েছেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম ফিফটি। মাহমুদউল্লাহ কী কী করেছেন, তার সিংহভাগ শুরুতেই বলা হয়েছে। যা বলা হয়নি, তা হলো ছক্কার সংখ্যা। এই ইনিংসে ৪টি ছক্কা মেরেছেন মাহমুদউল্লাহ। প্রথমটি মারার পরেই বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি ছক্কা মারায় ছাড়িয়ে গেছেন তামিম ইকবালকে। এই সংস্করণে তামিমের ছক্কা ১০৩টি, মাহমুদউল্লাহর এখন ১০৭টি।
ব্যাট হাতে দারুণ ফিনিশিংয়ের পর বাংলাদেশের বোলাররাও বেশ উজ্জীবিত ছিলেন। রান তাড়ায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১০০ পেরোনোর আগেই প্রথম ওয়ানডের নায়ক রাদারফোর্ড, অধিনায়ক শাই হোপসহ চার ব্যাটসম্যানকে আউট করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণটাও প্রায় নিয়ে নিয়েছিল বাংলাদেশ।
মাঝে বৃষ্টির কারণে ২৫ মিনিট খেলা বন্ধ ছিল। বৃষ্টি থামার পর খেলা শুরু হলে বল গ্রিপ করতে সমস্যায় পড়েন বাংলাদেশের তিন স্পিনার মিরাজ, নাসুম ও রিশাদ। এই সুযোগে দ্রুত রান তুলেছেন কিসি কার্টি ও আমির জাঙ্গু। দুজন থিতু হওয়ার পর রানের গতি শুধু বাড়িয়েই গেছেন।
ম্যাচটা যখন প্রায় হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন কিছুটা সম্ভাবনা জাগিয়েছিলেন রিশাদ। কার্টিকে ৫ রানের জন্য সেঞ্চুরিবঞ্চিত করার পর দুর্দান্ত রিটার্ন ক্যাচে ফেরান রোস্টন চেজকে।
এরপর আটে নামা গুড়াকেশ মোতি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন মারমুখী মেজাজে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়সূচক রানও এসেছে মোতির বিশাল এক ছক্কায়।
এর আগে জাঙ্গুও ছক্কা মেরে স্বপ্ন পূরণ করেছেন। ইতিহাসের ১৬তম ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২য় ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডে অভিষেকেই সেঞ্চুরি পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশকে তেতো স্বাদ দেওয়া জাঙ্গুই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ড্রেসিংরুমে ছড়িয়ে দিয়েছেন মধুময় আনন্দ।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩২১/৫
( ৮৪* মাহমুদউল্লাহ, ৭৭ মিরাজ, ৭৩ সৌম্য, ৬২* জাকের ; জোসেফ ২/৪৩, রাদারফোর্ড ১/৩৭, মোতি ১/৬৪)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ৪৫.৫ ওভারে ৩২৫/৬
( ১০৪* জাঙ্গু, ৯৫ কার্টি, ৪৪* মোতি ; রিশাদ ২/৬৯, তাসকিন ১/৪৯, হাসান ১/৫২, নাসুম ১/৫৬)।
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: আমির জাঙ্গু।
ম্যান অব দ্য সিরিজ: শেরফান রাদারফোর্ড।
সিরিজ: ৩ ম্যাচের সিরিজের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩–০ ব্যবধানে জয়ী।
আরও পড়ুন চ্যাম্পিয়নস ট্রফি: ২ শর্তে হাইব্রিড মডেলে রাজি পাকিস্তান
1 thought on “ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ধবলধোলাই বাংলাদেশ”