ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙ্গার ঘটনা ঘটছে। মাজারে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাকে ঘিরে মানুষজন আহতও হয়েছে, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইভেন্ট খুলেও মাজার ভাঙ্গার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
এর মাঝে নতুন করে আগামী ১১ই সেপ্টেম্বর ঢাকার গুলিস্তানে অবস্থিত গোলাপশাহ মাজার ভাঙ্গতে “গুলিস্তানে গোলাপশাহ মাজার ভাঙ্গা কর্মসূচি” শীর্ষক একটি ইভেন্ট খোলা হয়েছে, যাতে প্রায় ১৩ হাজার মানুষ সাড়া দিয়েছে। মূলত সুফি বা ধর্মীয় প্রচারকদের কবর বা সমাধি কেন্দ্রিক মাজার গড়ে ওঠে। যদিও ইসলামে মাজার ব্যবস্থা কতটা ধর্মসম্মত, তা নিয়ে ধর্মীয় বক্তা-আলেমদের মধ্যে নানামত রয়েছে।
বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোয় অনেক দেশে মাজার ঘিরে ব্যবসা, প্রতারণা, মাদক ব্যবহার বা অর্থ উপার্জনের অভিযোগ রয়েছে। তবে এভাবে হামলা করে মাজার ভাঙ্গা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন ইসলামিক নেতারা। কিন্তু কেন এমন ঘটনা ঘটছে? কারা ঘটাচ্ছে? এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা কী?
নারায়ণগঞ্জের দেওয়ানবাগ মাজারে হামলা
নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার মদনপুর এলাকায় দেওয়ানবাগ মাজার ভাঙ্গা হয়। জানা গেছে, গত শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে কিছু লোক ওই মাজারে ঢুকে ভাঙচুর করে। মাজারের ভেতরে থাকা লোকজন তাদেরকে আটকাতে গেলে হামলাকারীরা তাদেরকে মারধর করেন।
এই ঘটনা কারা ঘটিয়েছে, তা জিজ্ঞেস করলে ওই থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক বলেন, “সর্বশ্রেণির মাজার বিদ্বেষী, পীর বিদ্বেষী লোকজন এটা করেছে।” মদনপুর মাজার ভাঙ্গার আগে গত ২৫শে আগস্ট নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার সনমান্দি ইউনিয়নে আয়নাল শাহ দরগা নামে একটি মাজারও হামলা করে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিলো বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জের একাধিক মাজারে হামলা
গত এক সপ্তাহের মধ্যে সিরাজগঞ্জের দুইটি মাজারে হামলার ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ হামলার ঘটনা ঘটে গত তেসরা সেপ্টেম্বর। ওইদিন বিকালে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে ইসমাইল পাগলার মাজারে হামলা চালিয়ে ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে গত ২৯শে অগাস্ট সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার মনসুরনগর ইউনিয়নের বামনজানি বাজারের পাশে আলী পাগলার মাজারও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই মাজার হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দেখা যায়- হাতুড়ি,লাঠি-সোঁটা,শাবল হাতে একদল মানুষ মাজারের দেয়াল,ছাউনি, সবকিছু ভেঙ্গে ফেলছে।
হামলাকারীদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ এবং বেশিরভাগের পোশাক ছিল পাঞ্জাবী-টুপি। জানা যায়, এই ভাঙচুরে নেতৃত্ব দেওয়া শালগ্রাম জামে মসজিদের ইমাম গোলাম রব্বানীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেন গ্রামবাসী।
আরও জানা যায়, হামলার আগে মাদ্রাসা ছাত্রসহ আশপাশের গ্রামের কয়েক হাজার লোক স্থানীয় কান্দাপাড়া হাটে সবাই একত্রিত হয়েছিল। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে তারা মাজারে হামলা চালান। মাজারের বিভিন্ন স্থাপনায় আঘাত করার পর তারা দান বাক্স ও পাশেই থাকা খাদেমের ঘরে ভাঙচুর চালিয়ে নগদ টাকা ও মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।
এই দুই ঘটনার ব্যাপারে গনমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন। তিনি জানিয়েছেন যে তিনি ইসমাইল পাগলার মাজারে হামলার ব্যাপারে জানেন। কিন্তু আলী পাগলার মাজার ভাঙ্গচুর করার ঘটনা সম্বন্ধে তিনি কিছু জানেন না। ইসমাইল পাগলার মাজারে ভাঙ্গচুরের কারণ সম্বন্ধে তিনি বলেন, “মাজারে গাঁজা খায়। বাদ্যবাজনা বাজায়। তা পারিপার্শ্বিকতার জন্য ডিজগাস্টিং পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে।”
“মাজার পরিচালনা কমিটির লোকজন ও আশেপাশের ধার্মিক ও মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন তাদেরকে নিষেধ করার পরও এগুলো চলমান বিধায় দুই গ্রুপের মাঝে ঝামেলা হয়েছে।” তিনি জানান আরও জানান, সেখানে হামলার খবর শুনে তারা সেনাবাহিনীর সহায়তায় এটিকে প্রতিহত করেছে। সেইসাথে, ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে মামলা করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলায় ছোট-বড় প্রায় এক হাজারের মত মাজার আছে উল্লেখ করে জেলা পুলিশ আরও বলেন, “হামলা হতে পারে এমন মাজারে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে। কিছু হলে সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
ঠাকুরগাঁওয়ের বিবি সখিনার মাজার তছনছ
এদিকে, গত ১১ই জুলাই দিবাগত রাতে ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলা অবস্থিত তিনশ’ বছরের পুরোনো বিবি সখিনার মাজার ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে জানা যায়, কংক্রিটের ঢালাই ভেঙ্গে মাটি খুঁড়ে মাজার তছনছ করা হয়েছে।
এই মাজারে বছরের পর বছর ধরে অনেকে বিশ্বাস থেকে মানত করতে আসতো। বিবি সখিনার মাজার ভাঙ্গার বিষয়ে জানতে চাইলে ঠকুরগাঁও পুলিশ সুপার উত্তম প্রসাদ হামলার সত্যতা নিশ্চিত করতে পারেননি। এদিকে ঠাকুরগাঁও- জেলায় মাজারের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও সেখানকার ২৮ শতাংশ মানুষ হিন্দু ধর্মাম্বলী।
তাই, আসন্ন দুর্গা পূজা উপলক্ষে সেখানে যাতে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, তাই স্থানীয় জনগণকে সাথে নিয়ে সতর্ক অবস্থায় আছে পুলিশ। এমনটাই জানিয়েছেন জেলা পুলিশ সুপার।
গান-বাজনা নিষিদ্ধ সিলেটের শাহপরান মাজারে
দেশজুড়ে মাজারে হামলার ঘটনার মাঝে আলোচনায় এখন সিলেটের হজরত শাহপরান (রহ.) মাজার। গতকাল শাহপরান মাজার কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দেন যে ওরসের সময় সেখানে কোনও গানবাজনা হবে না।
মাজারের অন্যতম খাদেম কাবুল আহমেদ বলেন, “দেখা গেছে গান বাজনার আড়ালে মাজারে মাদক সেবন ও ব্যবসা করা হয়। আমরা খাদেমরা এগুলোর তীব্র নিন্দা জানাই। এখন থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার গান-বাজনা বন্ধ থাকবে। এ প্রসঙ্গে শাহপরাণ থানার ওসি হারুন অর রশীদ চৌধুরী বলেন, “এটা ঐরকম কোনও বিষয় না। এলাকাবাসী মিলে একটা প্রতিবাদ করছে।”
আগামী ৮, ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর শাহপরাণ মাজারে তিন দিন ধরে ওরস (ওয়াজ মাহফিল) অনুষ্ঠিত হবে।এই ওরস উপলক্ষে যত অসামাজিক কার্যকলাপ, যেমন মদের আসব বা নাচ-গান যেন না হয়, তাই এলাকাবাসী ও মাজারের খাদেম, সবাই একত্রিত গান বাজনা নিষিদ্ধ করেছে।
মাজার ভাঙ্গা যৌক্তিক?
মাজার ভাঙ্গা নিয়ে যে ধরনের ক্যাম্পেইন চলছে, সেটিকে অন্যায় মনে করছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। এই সংস্থার হালাল সনদ বিভাগের উপপরিচালক মো. আবু সালেহ পাটোয়ারীর সাথে এ নিয়ে কথা হয়। তিনি জানান, মাজার শব্দের অর্থ জিয়ারতের স্থান। কিন্তু আমাদের দেশে মাজার বলতে বোঝা যায়, যেখানে পীর-বুজুর্গর কবর। এই সব কবর কে পাকা করে অনেকে আলোকিত করে এবং অন্ধ ভক্ত মানুষ সেখানে জিয়ারতের জন্য যায়।
মাজার ভাঙা বা সংরক্ষণ করা নিয়ে বিভিন্ন মতামত রয়েছে। এটি মূলত ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের ওপর নির্ভর করে। ইসলাম ধর্মে কবর পূজা বা মাজারের সামনে সিজদা করার বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অনেক ইসলামী পণ্ডিত মনে করেন যে, মাজারে যাওয়া বা কোনো মৃত ব্যক্তির কবরকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় আচার পালন করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তাদের মতে, মাজারে যাওয়া বা মাজার তৈরি করা ইসলামের মূল শিক্ষার পরিপন্থী। একারণে, কিছু ইসলামি দল বা মতাদর্শ মাজার ভাঙার পক্ষে যুক্তি দেয়, যাতে কোনো ব্যক্তি শিরক বা বিদআতে লিপ্ত না হয়।
অন্যদিকে, উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে মাজার বা আউলিয়াদের কবরকে কেন্দ্র করে আধ্যাত্মিক চর্চা এবং লোকজ সংস্কৃতি বিকাশ লাভ করেছে। এই মতাবলম্বীরা মনে করেন, মাজারগুলি ধর্মীয় ও ঐতিহ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেগুলি সংরক্ষণ করা উচিত। বিশেষ করে যারা সুফি আধ্যাত্মিকতার অনুসারী, তারা মাজারকে একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করেন।
আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিরা মনে করতে পারেন যে, মাজার বা কবরকে ঘিরে কোনো ধরনের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া অযৌক্তিক এবং এটি সমাজে কুসংস্কারের প্রসার ঘটাতে পারে। তবে তারা মাজার ভাঙার পরিবর্তে এগুলোকে ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সংরক্ষণ করার পক্ষে থাকতে পারেন। তাহলে, মাজার ভাঙ্গা যৌক্তিক কি না, তা মূলত আপনার ধর্মীয় বিশ্বাস, সংস্কার এবং মানসিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর নির্ভর করবে।
মাজার ভাঙার ব্যাপারে সরকারের অবস্থান
কয়েকদিন ধরে দেশে চলা টানা মাজার ভাঙ্গার ঘটনা নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। আজ শনিবার মাজার ভাঙ্গা প্রসঙ্গে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান গণমাধ্যমে বলেছেন, “আমরা এ ব্যাপারটি খুব সিরিয়াসলি দেখছি। এই ধরনের ঘটনা যেন না ঘটে, সে ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি।” মাজারে হামলা “গ্রহণযোগ্য না” উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে যতদূর সম্ভব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়োজিত করে হামলা রোধ করা যায় সেই চেষ্টা চলছে।
হামলার বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলেছেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনও।রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়ায় অবস্থিত আল মারকাজুল ইসলামি আস সালাফি মাদ্রাসা পরিদর্শন শেষে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, “মাজার ভাঙ্গা হোক, মসজিদ ভাঙ্গা হোক, মন্দির ভাঙ্গা হোক; এগুলো গর্হিত কাজ। যেগুলো যেভাবে আছে, সেগুলো সেভাবে থাকা দরকার।”
“আমরা দেশবাসীকে জানাতে চাই, আমাদের কম্যুনাল হারমোনি-ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হওয়ার মতো কোনও ঘটনা যদি ঘটে, আপনারা আমাদের জানালে আমরা মুহূর্তের ভেতরে আইনগত ব্যবস্থা নিবো।”