বিএনপি’র চেয়ারপারসন তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা হয় ২০০৭ সালে। এরপর.২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর অনেকগুলো মামলা হয়। এসব মামলার মধ্যে ছয়টি বিষয়ে সাজা ঘোষণা করা হয়েছে। তবে কোন মামলাতেই তিনি সাজা ভোগ করেনি, পলাতক হিসেব দেখিয়ে বিচার হয়েছে এসব মামলার।
বিএনপি’র আইনজীবীদের দাবি রাজনৈতিকভাবে এ সকল মিথ্যা মামলায় তাকে ফাসানো হয়েছে। তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়কের আমলে ১৭ টি মামলা করা হয়। ওই সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে রাজনৈতিক নেতা ও ব্যবসায়ীদের আটক করা হয়। তারেক রহমানকে ওই বছরের ৭ই মার্চ গ্রেফতার করা হয়। পরের বছর ৩রা সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পেয়ে লন্ডন চলে যান।
পরবর্তীতে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে আরও ২০ টির বেশি মামলা দেওয়া হয় দেওয়া বলে জানায় আইনজীবীরা। তবে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রকৃত মামলার সংখ্যা এখনো জানেনা দলটির নেতারা।মানহানির অভিযোগে দেশের প্রত্যেকটি জেলায় মামলা হয়েছে যার তথ্য এখনো সঠিকভাবে জানা যায়নি।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা
২০০৪ সালে একুশে আগস্ট ঢাকায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক জনসভা চলার সময় গ্রেনেড হামলা করা হয়। সেই হামলায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা এবং দলটির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা প্রাণে বেঁচে গেলেও আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহিত হন।
এছাড়াও আহত হয়েছিলেন ৪০০ এর বেশি নেতা কর্মী। ঘটনার পর থেকেই আওয়ামী লীগ তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকার বিএনপি ও তার সহযোগীদের দায়ী মনে করেছেন। বিএনপি জামাত আমলে এই মামলার তদন্তের নামে ‘জর্জ মিয়া’ নাটক সাজানোর মাধ্যমে তদন্ত ভিন্ন খাতের নেওয়ার অভিযোগ রয়েছিলেন।
সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর হামলার ঘটনার পুনর্তদন্ত শুরু হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আবার এই মামলার অধিকতর তদন্ত শুরু করা হয়। এরপর তারেক রহমানকে প্রধান করে আরও ৩০ জনের নামে প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এ মামলার মোট আসামি ছিলেন ৫২ জন। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান কে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তার জবানবন্দীর পরে পুরো মামলার চেহারা অন্যরূপ নেয়।
বাংলাদেশের জঙ্গি তৎপরতা ও একের পর এক হামলার সাথে জড়িয়ে আছে এই মুফতি আব্দুল হান্নান। আদালতে উপস্থিত আব্দুল হান্নানের জবানবন্দিতে বলা হয়, বিএনপি সরকারের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সহায়তায় গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিলেন। জবানবন্দীতে আরো বলা হয়েছে,বিএনপি সরকারের উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাজ উদ্দিন এর মাধ্যমে পিন্টুর সাথে প্রথম যোগাযোগ হয়। এরপর তার মাধ্যমে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এর কাছে যান। সেখানে বলা হয় লুৎফর বাবর ও তৎকালীন কুমিল্লার নির্বাচিত সংসদ সদস্য কায়কোবাদকে সঙ্গে নিয়ে তারা হাওয়া ভবনে যান যেটি ছিল বিএনপি শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের কার্যালয়। সেখানে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, হারিস চৌধুরী, লুৎফুজ্জামান বাবর, ডিজিএফ এর তৎকালীন প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী এবং অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রহিম উপস্থিত ছিল। তাদের উপস্থিতির কিছুক্ষণ পর সেখানে তারেক রহমান আসেন বলে মুফতি হান্নানের জবানবন্দীতে উল্লেখ করা হয়েছে। মুফতি হান্নান আরো জানান তার সহযোগীরা যেন হাওয়া ভবনে আর না আসে সে বিষয়ে তারেক রহমান সতর্ক করে তাদের জানায়, আপনারা বাবর সাহেব ও আব্দুস সালাম পিন্টুর সঙ্গে যোগাযোগ করে কাজ করবেন।
২০১৮ সালে এই মামলার রায় দেন ঢাকার বিচারিক আদালত। ৫২ জন আসামীর মধ্যে তিনজনের অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় বাকি ৪৯ জনের বিরুদ্ধে রায় দেওয়া হয়। বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানকে এ মামলায় যাবজ্জীবন দেওয়া হয়। পলাতক হিসেবে এ মামলার ডেট রেফারেন্স ও আপিল বিভাগের শুনানি চলছে। তবে ৫ই আগস্টের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতে ব্রেঞ্চ পরিবর্তন হওয়ার পর এই মামলার আসামিপক্ষ শুনানির আরও সময় আবেদন করে। বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল জানান, এই মামলার মোট পাঁচটা চার্জশিট দাখিল করা হয়েছিল এবং চতুর্থ চারিটিতেও তারেক রহমানের নাম ছিল না, কিন্তু ২০০৯ সালে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর পঞ্চম চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম দেওয়া হয়। এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির অভিযোগে ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে পাওয়া দুই কোটি ১০ লাখ টাকার বেশি অর্থ ট্রাস্ট এর কাজে ব্যবহার করা হয়নি এবং নিজেরা সেই টাকা আত্মসাৎ করে উল্লেখ ছিল এই মামলার অভিযোগ। এই মামলায় বিএনপি’র চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয় যা পরবর্তীতে হাইকোর্ট ১০ বছরে বাড়ায়।
একই সাথে তারেক রহমান সহ অন্য পাঁচ আসামিকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।গত ৫ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর রাষ্ট্রপতির আদেশে খালেদা জিয়াকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। বিএনপি’র আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল জানান, ১/১১ সময় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ১৭ টি মামলার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় এবং সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা সাজা হয়েছে। এছাড়া কর ফাঁকি ও চাঁদাবাজির মামলায় স্থগিত রয়েছে।
জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের মামলায় কারাদণ্ড
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান ও তার মা সৈয়দা ইকবাল বেগমের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের মামলাটি করেছিল দুদক। মামলার অভিযোগ ছিল, তারেক রহমান ও তার স্ত্রীর ঘোষিত আয়ের বাইরেও চার কোটি ৮০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ রয়েছে। গতবছরের ২ রা আগস্ট এই মামলায় তারেক রহমানকে নয় বছরের ও জুবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
অর্থপাচার মামলা
২০১৩ সালের ১৭ ই নভেম্বর সিঙ্গাপুরে অর্থপাচারের অভিযোগের মামলায় ঢাকার একটি আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেয়। ওই মামলায় তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন কে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারিক আদালতের খালাসের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন দুদক। ২০১৬ সালে বিচারিক আদালতের খালাস বাতিল করে ৭ বছরের সাজা দেয় হাইকোর্ট। পাশাপাশি ২০ কোটি টাকার জরিমানাও করা হয়।
মানহানির মামলায় দণ্ড
২০১৪ সালে লন্ডনের এক সমাবেশে শেখ মুজিবুর রহমান কে রাজাকার ও পাক বন্ধু বলে অভিহিত করে তারেক রহমান। নানা অবমাননা করেন বলে অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগে সে সময়ে নড়াইলে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস। ওই মামলায় ২০২১ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানের বিরুদ্ধে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় নড়াইলের আদালত। শুধুমাত্র ঢাকার আদালতেই মানহানির অভিযোগে দশটির বেশি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। শেখ মুজিবের অবমাননা ও কটুক্তির অভিযোগ এ্নে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা হয়। তবে এইসব মামলার প্রকৃতি হিসেব নেই বলে জানান বিএনপির আইন সম্পাদক কায়সার কামাল।
রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাও, ২০১৫ সালের ৮ই জানুয়ারি তেজগাঁও থানায় করা মামলায় তারেক রহমান ও একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে জোগ সাজেশ করে ও মিথ্যা বিভ্রান্তি করে তথ্য প্রচার করে তথ্য প্রচার করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকির অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়। তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা রয়েছে। এছাড়া নোয়াখালীতে রাষ্ট্রদ্রোহের আরেকটি মামলা রয়েছে যেখানে গ্রেফতারী পরোয়ানা রয়েছে। এছাড়া সারাদেশে ডিজিটাল তথ্য প্রযুক্তির মামলাও হয়েছে। ২০২০ সালের.২জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কে হত্যার হুমকির অভিযোগে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ঢাকার সি এম এম আদালতে মামলা করেন জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী।
বিএনপি’র আইন সম্পাদক জানান, তারেক রহমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল তাই তিনি আইনীয়ভাবেই এই মামলাগুলোর মোকাবেলা করবেন।