বাঙালির গুজব কিছু সত্য বটে

বাঙালির গুজব কিছু হলেও সত্য বটে

বাংলাদেশ
Spread the love

বাংলা সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গুজবের ভূমিকা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয় বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গতিশীলতার একটি প্রতিচ্ছবি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনা বা অভিজ্ঞতার মধ্যে বাঙালির গুজব প্রায়ই এমন এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে থাকে যেখানে একধরনের ‘মজার চক্র’ তৈরি হয়। সেই সাথে  গুজব এক প্রকার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তথ্য বা গল্প, যা অনেকসময় সত্য হতে পারে কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর ভিত্তি খুবই দুর্বল বা কাল্পনিক।

বাঙালি সমাজে গুজবের শেকড় অনেক পুরানো। এককালে তেঁতুলতলার বৈঠক থেকে শুরু করে চায়ের দোকান, হাট-বাজার, এমনকি আজকের সোশ্যাল মিডিয়া—গুজবের বিস্তার সকল স্তরেই বিদ্যমান। তাত্ত্বিকভাবে বললে, গুজব এমন একটি ঘটনা বা তথ্য যা অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণ বা অপ্রমাণিত। তবে এর উৎস খুব দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং মানুষের বিশ্বাস বা আগ্রহের কারণেই তা বেশি প্রভাব ফেলে।

গুজবের প্রকৃতি

বাঙালির গুজব প্রায়ই সামাজিক, রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়। অনেক গুজব মজার, হাস্যরসাত্মক এবং বিনোদনমূলক হলেও কিছু গুজব আতঙ্ক এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, অতীতে চোরাচালানকারী বা দুর্নীতি সংক্রান্ত গুজবগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচুর কৌতূহল ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করত। আবার একইভাবে, ভৌতিক বা অলৌকিক গুজব সমাজের অজানা ভয়ের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের উত্থানের পর থেকে এই গুজবের ধরনও পরিবর্তিত হয়েছে, বিশেষ করে প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এই গুজব ছড়ানোর গতি ও ব্যাপ্তিও অনেক বেড়েছে।

বাঙালির গুজবের বিখ্যাত উদাহরণ

১. ‘টালা’ খালাস হবে: একটা সময় ছিল যখন বলা হতো যে, সরকারের কাছ থেকে প্রত্যেক নাগরিক টাকা পাবে। এই ধরনের গুজব সাধারণ মানুষকে প্রচুর আশাবাদী করত এবং এতে বহু মানুষ বিশ্বাস করত। কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুই ঘটেনি।

২. ‘বাবা এসে যাচ্ছে’: এক সময় বলা হতো এক ‘বাবা’ বা অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন এক মানুষ রাতের বেলা এসে মানুষের উপর আক্রমণ চালাবে। এটাও বহু পরিবারে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল।

৩. ‘বিজলী ঠাকুর’: ছোট ছোট শিশুদের ভয় দেখানোর জন্য বলা হতো ‘বিজলী ঠাকুর’ এসে তাকে নিয়ে যাবে যদি সে বেশি জেদ করে। এ ধরনের গুজব শিশুদের শৃঙ্খলার মধ্যে রাখতে অনেক অভিভাবক ব্যবহার করতেন।

৪. রাজনৈতিক গুজব: রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও প্রচুর গুজবের উদ্ভব হয়। নির্বাচন বা সরকার পরিবর্তনের সময় অনেক সময় অপ্রমাণিত খবর ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের গুজব সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে এবং সমর্থকদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করে।

৫. স্বাস্থ্য সংক্রান্ত গুজব: বিভিন্ন সময়ে বাঙালি সমাজে স্বাস্থ্য নিয়ে গুজবের উদ্ভব হয়েছে। একসময় বলা হয়েছিল এক ধরনের ফল খেলে তা শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। মহামারির সময়ে বিভিন্ন ওষুধ বা প্রতিষেধকের অপ্রমাণিত গুজবও মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে।

গুজবের প্রভাব

গুজবের সবচেয়ে বড় প্রভাব হল তার দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ক্ষমতা। এটি এক মুহূর্তে সমাজের একটি বিশেষ অংশকে উদ্বিগ্ন করে তুলতে পারে। একটি গুজবের প্রভাব কেমন হতে পারে তা নির্ভর করে গুজবের বিষয়বস্তু, শ্রোতাদের মানসিকতা এবং সময়ের ওপর।

১. ভীতি ও আতঙ্ক:

গুজব অনেক সময় সমাজের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। যেমন ১৯৭০-এর দশকে এক গুজব ছড়ায় যে কোনো এক ভূত প্রতিশোধ নিতে আসছে। এই ধরনের গুজব সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করে তোলে এবং বহু মানুষ রাতে বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দেয়।

২. সামাজিক বিশৃঙ্খলা:

কিছু গুজব এমনভাবে ছড়ায় যে সমাজের একটি অংশের সাথে আরেকটি অংশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ধরনের গুজবের ফলে অনেক সময় সামাজিক শান্তি বিঘ্নিত হয় এবং বিশেষ করে দাঙ্গা-হাঙ্গামারও সৃষ্টি হতে পারে।

৩. মানুষের আস্থা নষ্ট করা:

কিছু গুজব সমাজের মধ্যে মানুষের আস্থা কমিয়ে দেয়। যেমন রাজনৈতিক গুজব অথবা সরকারের ওপর ভিত্তিহীন খবর মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং তাদের আস্থায় চিড় ধরায়।

৪. গুজবের ব্যবসায়িক প্রভাব:

অনেক সময় গুজবের প্রভাবে ব্যবসায় ক্ষতি হয়। বিশেষ করে যখন কোনো পণ্যের গুণাগুণ বা ক্ষতির বিষয়ে গুজব ছড়ায়, তখন সেই পণ্যের চাহিদা কমে যায়। এছাড়া, স্বাস্থ্য সম্পর্কিত গুজব অনেক সময় মানুষকে চিকিৎসার ভুল পথ দেখাতে পারে।

গুজবের মনস্তত্ত্ব

বাঙালির গুজবের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায় যে গুজবের প্রতি মানুষের আকর্ষণ মূলত দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে:

১. কৌতূহল ও মজা: মানুষের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে একধরনের কৌতূহল থাকে। অজানা তথ্য বা ঘটনা নিয়ে মানুষ জানতে চায় এবং সেই অজানার প্রতি আকর্ষণ থেকেই গুজবের বিস্তার হয়। আর এই আকর্ষণের মাধ্যমেই গুজব মুখ থেকে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।

২. সন্দেহ ও অবিশ্বাস: কিছু গুজব সমাজে মানুষের মধ্যে বিদ্যমান অবিশ্বাস থেকে উদ্ভব হয়। বিশেষ করে রাজনীতি বা সরকার সম্পর্কিত গুজব মানুষ বিশ্বাস করে, কারণ তাদের মাঝে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি একধরনের সন্দেহ ও অবিশ্বাস রয়েছে।

প্রযুক্তি ও সামাজিক মিডিয়া

সামাজিক মিডিয়ার অগ্রগতির ফলে গুজবের বিস্তার বহুগুণ বেড়ে গেছে। এখন একটি ছোটখাট ঘটনা মাত্র কয়েক মিনিটে সারা দেশ বা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়তে পারে। প্রায়শই কিছু মানুষ মিথ্যা তথ্য পোস্ট করে এবং তার পরে সেই তথ্য ভাইরাল হয়ে যায়। এর ফলে এমন অনেক ঘটনাও ঘটেছে যেখানে গুজবের কারণে ভীতি বা সংঘাতের সৃষ্টি হয়েছে।

গুজব প্রতিরোধে করণীয়

গুজব প্রতিরোধের জন্য তথ্য যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালি সমাজে গুজব প্রতিরোধে বিভিন্ন সচেতনতা প্রচারণা চালানো যেতে পারে। এটি মানুষের মধ্যে তথ্যের প্রতি আস্থা তৈরি করে এবং গুজবের প্রভাব কমিয়ে আনে। প্রযুক্তিগত ভাবে, সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোকে গুজব বা ভুল তথ্য শনাক্ত করতে উন্নত ফিল্টার ব্যবহার করতে হবে।

গুজব অনেক সময় সমাজের মধ্যে মজার রস তৈরি করতে পারে, কিন্তু এটার নেতিবাচক প্রভাবগুলোও যথেষ্ট। অতএব, গুজবকে স্বাভাবিক ঘটনা মনে করলেও, সমাজের সুরক্ষার জন্য তা সচেতনতার সঙ্গে মোকাবিলা করাই গুরুত্বপূর্ণ।

1 thought on “বাঙালির গুজব কিছু হলেও সত্য বটে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *