রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ

রাজনীতি ছাড়তে চান আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা

বাংলাদেশ
Spread the love

গত ২৩শে জুন ২০২৪, ঘটা করে দলের ৭৫ বছরপূর্তি পালন করেছিল আওয়ামী লীগ। সেদিন ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত সমাবেশে নেতাকর্মীর উপস্থিতি ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। কিন্তু এখন মাত্র ২ মাসের ব্যবধানে পরিস্থিতি পুরোপুরি পাল্টে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাজনীতি ছাড়তে চান আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা।

গত পাঁচই অগাস্ট গণ-আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। শীর্ষ নেতারাও অনেকে দেশ ছেড়েছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেউ কেউ ‘দেশ ছাড়ার চেষ্টাকালে’ গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়া বাকি নেতাদের মধ্যে এখনও যারা দেশে অবস্থান করছেন, তাদের প্রায় সবাই ‘আত্মগোপন’ করেছেন।

এমন অবস্থায় গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে চরম নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দিয়েছে। যার ফলে সাংগঠনিকভাবে দলটির সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বলে গনমাধ্যমকে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তাদের অনেকেই এখন উদ্বেগ ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কথা বলার সময় কেউ তাদের নামও প্রকাশ করতে চাননি।

“আমাদের দলের এখন দিশাহারা বিপর্যস্ত অবস্থা হয়ে গেছে। একমাস হয়ে গেলো অথচ কেন্দ্র থেকে কার্যকর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হলো না। ফোন দিলেও কেউ ধরে না। হামলা-মামলা সব মিলিয়ে নেতাকর্মীরা হতাশ,” জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের জেলা পর্যায়ের একজন নেতা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, নেতাকর্মীদের অনেকে রাজনীতি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাবছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

অপরদিকে, দলের সিনিয়র নেতাদের দায়ী করছেন আওয়ামী লীগের এখনকার তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকরা। কোটি কোটি টাকা বানাইলো নেতারা, আর এদের পাপের শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের,” ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন ওই ব্যক্তি। এদিকে, গত পাঁচই অগাস্টের পর গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশ সক্রিয় অবস্থান দেখা গেলেও এখন আর সেটি চোখে পড়ছে না। তবে পরিস্থিতি যত খারাপই হোক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আবারও ঘুরে দাঁড়াবে বলে জানাচ্ছেন দলের শীর্ষ নেতারা।

ঘরছাড়া নেতা-কর্মীরা

গত ৫ই আগস্ট দল ক্ষমতা হারানোর পর গত একমাসে ঢাকাসহ অনেক জেলাতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে।চাঁদপুর, কিশোরগঞ্জ, লালমনিরহাটসহ বেশ কয়েকটি জেলায় গণপিটুনি ও আগুনে পুড়ে বেশ কয়েকজন প্রাণও হারান।

“৫ই আগস্ট ক্ষমতা হারানোর পরে  পরিবার-পরিজন নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কবে এলাকায় ফিরতে পারবো, তাও জানি না,” কথাগুলো বলছিলেন মধ্যমসারির আওয়ামী লীগের এক নেতা। ঢাকার কাছাকাছি একটি জেলায় তাদের পৈত্রিক বাড়িতে হামলা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন। এছাড়া এলাকায় তার যত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল, গত পাঁচই অগাস্টের পর সবগুলোই দখল করে নেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা বলেন“  একটা স মিল আছে,দু’টো সার-সিমেন্টের দোকান আছে এলাকার একটা বাজারে যা আমি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। সবকিছু  বেদখল হয়ে গেছে। পরিবার,সন্তানদের নিয়ে সামনে কীভাবে চলবো, কোথায় দাঁড়াবো, সেটা নিয়েই চিন্তায় আছি,” বলেছেন ওই নেতা। কারা বেদখল করেছে জানতে চাইলে বলেন“যারা মনে করতেছে ক্ষমতা হাতে পেয়ে গেছে, তারাই এটা করেছে,এইটুকুই শুধু বলেন তিনি।

অন্যদিকে, খুলনার মহানগর আওয়ামী লীগের এক নেতা জানিয়েছেন যে, তাদের এলাকার বেশিরভাগ নেতাকর্মী এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।

‘আর কখনো রাজনীতি করবো না’

হামলার ভয়ে নিজেরা গা ঢাকা দিলেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বেশিরভাগের পরিবার-পরিজন তাদের এলাকাতে রয়েছেন। তবে আয়-রোজগার না থাকায় সংসার চালাতে গিয়ে অনেকের স্ত্রী-সন্তানরা বিপাকে পড়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। কাজ কর্ম করবো কী করে“আমরা নিজেরাই তো পালিয়ে বেড়াচ্ছি? আর আয় না থাকলে সংসারের কী অবস্থা হয়, তা তো বুঝতেই পারছেন?বলেছিলেন পালিয়ে ঢাকায় আশ্রয় নেওয়া ফরিদপুরের আওয়ামী লীগ কর্মী।

আমার ঘরে ছোট দু’টো ছেলে, তারা এখন কী খাবে,কী ভাবে খাবে? বলছিলেন ওই আওয়ামী লীগ কর্মী। এ অবস্থায় সপ্তাহখানেক আগে সন্তানদের নিয়ে তার স্ত্রী বাবার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন তিনি। আমি ভাবতেই পারি না,ভাবতে গেলেই আমার কষ্ট হয়,কান্না পায়, এভাবে জানি না আর কতদিন থাকবে? জীবনে আর কখনো রাজনীতি করবো না, রাজনীতি করাই  যেন মহাপাপ হয়েছ, বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফরিদপুরের ওই আওয়ামী লীগ কর্মী।

‘আপা পালাইছে, মানতেই কষ্ট হয়’

আওয়ামীলীগের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কয়েকদিন আগে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলে গুঞ্জন শোনা গিয়েছিল যে, প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে শেখ হাসিনা পলায়ন করেছেন। তখন প্রতিক্রিয়ায় গত ২৪ জুলাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেনে যে, শেখ হাসিনা পালায় না।

কিন্তু পরে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর গত পাঁচই অগাস্ট দুপুরে হেলিকপ্টারে করে ভারতে পালিয়ে যান, যা এখনও মানতে পারছেন না দলটির নেতাকর্মীরা। আওয়ামীলীগের ঢাকা জেলার এক নেতা বলেন;’আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারি না। আপা পালাইছে,মানতেই কষ্ট হচ্ছে ” 

তিনি আরও বলেন“আপা দেশে থাকলে আওয়ামীলীগ্রের মনে বল পেতেন। ফলে দলে অন্তত বিপর্যয় দেখতে হতো না,” বলছিলেন ঢাকা জেলার ওই নেতা। এর পূর্বে ক্ষমতা হারানোর পর খালেদা জিয়া দেশ ছাড়েননি, এমনকি এরশাদের মতো স্বৈরাচারও দেশ থেকে পালায়নি। সেখানে নেত্রী শেখ হাসিনা কেন দেশ ছাড়লো , সেটাই আমরা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না,” বলছিলেন ওই নেতা।

মামলায় জর্জরিত নেতারা

৫ই আগস্টের পর থেকেই পালিয়ে থাকা অবস্থাতেই একাধিক মামলায় আসামি হচ্ছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী নেতারা। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই সারা দেশে শতাধিক মামলা হয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগই হত্যা মামলা।

ওইসব মামলার আসামির তালিকায় তার শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের শীর্ষনেতাদের অনেকের নাম রয়েছে। এর বাইরে, জেলা পর্যায়ে তৃণমূলের নেতাদের বিরুদ্ধেও অসংখ্য মামলা হতে দেখা যাচ্ছে। দেশে  যখন পরিস্থিতি আরও শান্ত হয়ে আসবে আদালতে গিয়ে মামলার জামিন নিবেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

চাপে গোপালগঞ্জের নেতারা

আওয়ামী সভাপতি শেখ হাসিনা গত পাঁচই অগাস্ট পালিয়ে যাওয়ার পর সারাদেশের দলীয় নেতাকর্মীরা যখন ‘আত্মগোপনে’ তখন ঠিক উল্টো চিত্র দেখা যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিজ জেলা গোপালগঞ্জে।

গোপালগঞ্জের নেতা-কর্মীরা পরপরই বেশ কয়েক দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে। তারদের দাবি শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।  করে সেসময় বিক্ষোভ মিছিল থেকে সেনা সদস্যদের উপর হামলার ঘটনাও ঘটেছিল, যা নিয়ে পরবর্তীতে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘দুঃখপ্রকাশ’ করেছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।

কিন্তু গত ১৫ই অগাস্টের পর গোপালগঞ্জেও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদেরকে আর আগের মতো সক্রিয়া দেখা যাচ্ছে না। সেনা সদস্যদের উপর হামলার পর থেকেই গোপালগঞ্জের আওয়ামীলীগের উপর চাপ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে গত চৌঠা সেপ্টেম্বর যৌথ অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এরপর গ্রেফতার আতঙ্কে নেতাদের অনেকেই রাতে নিজ বাড়িতে থাকছেন না বলেও জানা যাচ্ছে।

আওয়ামীলীগের হাল ধরবে কে?

শেখ হাসিনা গত ৫ই আগস্ট বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পর তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ভিডিও বার্তায় জানায়, তার মা শেখ হাসিনা আর কখনো রাজনীতিতে ফিরবেন না। “আমার মনে হয় এখানেই শেষ। আমার পরিবার এবং আমি- আমাদের যথেষ্ট হয়েছে,” গনমাধ্যম কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন।

যদি কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য জয়ের ভিন্ন সুর শোনা যায়। অন্যদিকে, দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় বহু নেতারাও ‘আত্মগোপনে’ রয়েছেন। গ্রেফতার হয়েছেন অনেকে। ফলে নেতৃত্বশূন্যতা অনুভব করছেন বলে জানিয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

আওয়ামী লীগের পরবর্তী নেতৃত্বের বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ঘোষণা এখনো দেওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন সম্ভাব্য নেতা ও নেতৃত্বের নাম শোনা যায়। বর্তমানে শেখ হাসিনা দলটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার নেতৃত্বে দলটি দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় আছে। শেখ হাসিনা দলের অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয় এবং দক্ষ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবে তার উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা উঠেছে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব নিয়ে কয়েকটি সম্ভাবনা রয়েছে: শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় রাজনৈতিকভাবে আলোচিত এবং তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার বিভিন্ন উদ্যোগে তিনি যুক্ত ছিলেন। তবে সরাসরি তিনি কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেননি।

আবার,আওয়ামী লীগের অনেক প্রবীণ ও অভিজ্ঞ নেতা রয়েছেন যারা ভবিষ্যতে নেতৃত্বের জন্য বিবেচিত হতে পারেন। অন্যদিকে অনেকে মনে করেন আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের নেতাদের মধ্যেও নেতৃত্বের সম্ভাবনা রয়েছে, যারা দলের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি হতে পারেন। তবে দলীয় সম্মেলন বা শেখ হাসিনার পরবর্তী পদক্ষেপ না জানা পর্যন্ত এ বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়।

 

1 thought on “রাজনীতি ছাড়তে চান আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *