আওয়ামীলীগের নেতারা দেশ

আওয়ামীলীগের যেসব নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে

বাংলাদেশ
Spread the love

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকার পতনের এক মাস পরও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মী, সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য অবৈধভাবে দেশত্যাগের চেষ্টা করছেন। ইতিমধ্যে আওয়ামীলীগের অনেক নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। পালাতে গিয়ে সীমান্তে ধরাও পড়েছেন কেউ কেউ। সীমান্ত পার হতে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে।

একাধিক উৎস থেকে পাওয়া তথ্য মতে, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক  ও সাবেক সংসদ সদস্য আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গত এক সপ্তাহে সীমান্ত এলাকা পাড়ি দিয়েছেন। এঁদের আগে (৫ আগস্টের পর) দেশ ত্যাগ করেছেন আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী (নওফেল), সাবেক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত, সাবেক সংসদ সদস্য আলাউদ্দিন আহমেদ (নাসিম) ও সহ অনেকে। যাঁরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন অথবা পালানোর চেষ্টায় করছেন, তাঁরা প্রায় সবাই হত্যাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় মামলার আসামি। তাই প্রশ্ন উঠেছে,  আওয়ামী সরকার পতনের এতদিন পরেও কীভাবে এসব ব্যক্তি দেশ ছেড়ে পালাতে পারছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ, সাবেক মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আরও বেশ কয়েকজন নেতার দেশ ছাড়ার গুঞ্জন রয়েছে। তবে তাঁদের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকেরই ধারণা, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরপর ওবায়দুল কাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় আশ্রয় নেন। পরে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত চলে যান। সাবেক একজন মন্ত্রী প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি শুনেছেন ওবায়দুল কাদের এখন দুবাই আছেন।

শেখ হাসিনার নিকটাত্মীয় ও সাবেক সাংসদ আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ছেলে ও বরিশালের সাবেক মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ, সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল উদ্দিন ও তাঁর ছেলে শেখ সারহান নাসের (তন্ময়), হেলালের ভাই সাবেক সংসদ সদস্য শেখ সালাহউদ্দিন জুয়েল এখনো দেশ ছাড়ার সুযোগ পাননি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে তাঁরা দেশের ভেতরে অবস্থান করছেন।

শেখ হাসিনার আরেক আত্মীয় আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগেই ভারতে চলে যান। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ৩ আগস্ট রাতে পরিবারসহ দেশ ছাড়েন। কিন্তু তাপসের ভাই ও যুবলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি শেখ ফজলে শামস (পরশ) দেশ ত্যাগ করতে পারেনি, তিনিও দেশে আছেন বলে জানা গেছে।

সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালও আন্দোলনের সময় সপরিবার সিঙ্গাপুরে চলে যান। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের (বিপু) অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান অবশ্য সরকার পতনের পর শুরুতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন। বিদেশ যাওয়ার চেষ্টাকালে গ্রেপ্তার হয়েছেন সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদও। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ৩০ জন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

প্রভাবশালী অন্তত ১৫ জন কেন্দ্রীয় নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের নাম বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে।  কিন্ত অবৈধ পথে  আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা দেশ ত্যাগ করায় ইমিগ্রেশন বিভাগের নথিতে পলাতকদের কোন তথ্য নেই। এছাড়া আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান নেতাদের মধ্যে ২৭ জনের দেশ ছাড়ার খবর পাওয়া যায় । তবে দেশ ত্যাগ করে পালানো ব্যক্তিদের প্রকৃত সংখ্যা প্রায় হাজারের মত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ ছাড়া পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ৫ আগস্টের কিছুদিন আগে বিদেশে পাড়ি জমিয়ে আর দেশে ফেরেননি আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের এমন অন্তত ১৩ নেতার নাম জানা গেছে।

কিভাবে অবৈধ পথে দেশ ত্যাগ করছে,এই বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সীমান্তে সরকার নজরদারি করছে। যার ফলে সাবেক সংসদ সদস্যসহ সাবেক বিচারপতিরাও গ্রেফতার হয়েছে। এই তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।

আরও দেশ ছেড়েছেন যাঁরা

ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর থেকে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি মধ্যম ও নিম্ন সারির অনেক নেতাও দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এ ছাড়া অনেকে পালানোর সুযোগ খুঁজছেন বলে জানা গেছে। যাঁদের বেশির ভাগের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে।

এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগের আরও যেসব নেতার দেশত্যাগের খবর পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন (রাজশাহী সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র), সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ (জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ) ও শফিউল আলম চৌধুরী (নাদেল), ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক আমিনুল ইসলাম, দলের দপ্তর সম্পাদক ও শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া, কার্যনির্বাহী সদস্য নির্মল কুমার চ্যাটার্জি, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস,। এ ছাড়া কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার ও তাঁর মেয়ে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র তাহসিন বাহা্‌ সাবেক নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, এবং ফেনীর সাবেক আলোচিত সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীও দেশ ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।

এই তালিকায় আরও রয়েছেন সাবেক ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য মাইনুল হোসেন (নিখিল), ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম সারোয়ার কবির, যুবলীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জয়দেব নন্দী, ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি লিয়াকত শিকদার, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির(শয়ন)।

কোন পথে, কীভাবে দেশ ছাড়ছেন

বিভিন্ন সময় দেশ ত্যাগ করেছেন এমন কয়েকজনের পরিবার, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সূত্রে জানা যায়, সিলেট, আখাউড়া (ব্রাহ্মণবাড়িয়া),  নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ (হালুয়াঘাট), যশোর অঞ্চল, লালমনিরহাটসহ উত্তরাঞ্চলীয় বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়ার প্রবণতা বেশি। দেশ ত্যাগে সাহায্য করার জন্য সীমান্তের দুই পাশের দালালরা জনপ্রতি ৫০ হাজার থেকে ২৫-৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত টাকা নেয় ।

ভারতে পালানোর সময় গত ২৩ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে স্থানীয় লোকজনের হাতে ধরা পড়েন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক)। স্থানীয় লোকজনের ধারণ করা একটি ভিডিওতে তখন তাঁকে বলতে শোনা যায়, তিনি ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। যাঁদের সহায়তায় তিনি পালাচ্ছিলেন, তাঁরা তাঁর কাছে থাকা ৬০-৭০ লাখ টাকা নিয়ে গেছেন এবং সীমান্তের ওপারে নিয়ে মারধর করেছেন।

২৪ আগস্ট রাতে সিলেটের কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় মারা যান ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান (পান্না)। লাশ উদ্ধারের পর মেঘালয় পুলিশ সূত্র গণমাধ্যমকে বলেছে, গলা টিপে শ্বাসরোধের কারণে ইসহাকের মৃত্যু হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তে আটক হন চট্টগ্রামের রাউজানের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী।

পলাতক অন্য ব্যক্তিরা কোথায়

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীসহ ওই সরকারের সুবিধাভোগীরা আত্মগোপনে চলে যান। এর মধ্যে দেশের বিভিন্ন সেনানিবাসে ৬২৬ জন আশ্রয় নেন বলে ১৮ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়। আশ্রয় নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনীতিক, বিচারক, প্রশাসন ও পুলিশের কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তাঁদের মধ্যে কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও বাকিরা সেনানিবাস থেকে বের হয়ে কোথায় অবস্থান করছেন, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায়নি। তবে তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ দেশ ছেড়েছেন বলে প্রচার আছে।

আলোচিত হাবিবুর রহমান,ডিবির সাবেক হারুন অর রশীদ,পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম সহ আরও বেশ কয়েকজন পুলিশের কর্মকর্তা আত্মগোপনে রয়েছে। আবার আত্মগোপনে থাকা আলোচিত ওসি বিপ্লব কুমার সহ অনেকেই গ্রেপ্তার এড়াতে দেশ ছেড়েছেন বলে ঘনিষ্ঠদের দিয়ে সূত্রে জানা যায়।

তাঁরা কীভাবে ভারতে আছেন

ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না বা পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া পলাতক ব্যক্তিদের বিষয়ে সহনশীল আচরণ করছে বলে জানা গিয়েছে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ । পলাতক অনেক নেতার যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশে বসবাসের অনুমতি বা গ্রিন কার্ড রয়েছে। আবার ভারতের ইমিগ্রেশন বিভাগকে ‘ম্যানেজ’ করে অনেকেই  অন্য দেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন । সিলেট সিটি করপোরেশনের সদ্য সাবেক মেয়র আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী এই ম্যানেজ প্রক্রিয়ায় ভারত থেকে লন্ডনে চলে গিয়েছে বলে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কেউ কেউ অবৈধ পথে ভারতে গিয়ে দালালের মাধ্যমে পাসপোর্টে বাংলাদেশ থেকে বহির্গমন ও ভারতের প্রবেশের সিল লাগানোর ব্যবস্থা করছেন।

বিত্তশালীরা পালিয়েছেন, কর্মীরা কষ্টে

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিপুল অর্থের মালিক আওয়ামী লীগের এমন নেতাদের দেশ ছাড়ার প্রবণতা বা চেষ্টা বেশি। এ নিয়ে দেশে অবস্থান করা আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের ১১ জন নেতার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেন, দেশ ছাড়ার পর নেতারা আর দেশে থাকা নেতা-কর্মীদের কোনভাবে যোগাযোগ বা খোজ নিচ্ছে না। আগের ফোন নাম্বার বা অন্য যোগাযোগ মাধ্যম গুলো বন্ধ করে রাখায় বিপদে আছেন তৃণমূলের অসচ্ছল নেতা-কর্মীরা।

হত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামিদেরও সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক নাইম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ভারতে যাচ্ছেন, তাঁরা তো আগে দেশের ভেতর দিয়েই সীমান্তে যান। তাঁরা কীভাবে সীমান্তে যাচ্ছেন, সেটা জানা জরুরি। পাশাপাশি তল্লাশিচৌকি বসিয়ে নজরদারি জোরদার করতে হবে। এ ছাড়া সীমান্তে মানব পাচারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *