বিএনপির ‘অবাধ্য’ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ

বিএনপির ‘অবাধ্য’ নেতাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ

বাংলাদেশ
Spread the love

সারা দেশে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের ‘অবাধ্য’ নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের স্তূপ পড়েছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর হামলা, দখল, অর্থ দাবি, আধিপত্য বিস্তার এবং দলীয় নির্দেশনা অমান্য করাসহ সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গত দুই মাসে এক হাজারের বেশি নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে বহিষ্কার, অব্যাহতি, পদাবনতি ও কমিটি বাতিল করার মতো কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরও অভিযোগ আসা এখনো থামেনি।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিভিন্ন স্থানে নেতা-কর্মীদের একটি অংশ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়ায়। ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে এসে গেছে ধরে নিয়ে তাঁরা কোথাও হামলা, চাঁদাবাজি, দখল, আবার কোথাও আধিপত্য বিস্তারে সংঘর্ষ ও হাঙ্গামায় লিপ্ত হন। তাঁদের নিবৃত্ত করতে শীর্ষ নেতৃত্বকে শাস্তিমূলক সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হয়। দলের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এত কম সময়ে এত বিপুলসংখ্যক নেতার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘটনা বিএনপিতে এই প্রথম।

তবে এই ‘অবাধ্য’ নেতা-কর্মীদের গত দুই মাসের কর্মকাণ্ড ১৫ বছর ধরে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার দলকে সমালোচনার জায়গায় নিয়ে গেছে বলে মনে করেন বিএনপি নেতারা। যার ফলে একটি বড় রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আগামী দিনের রাজনীতিতে বা ক্ষমতায় গেলে বিএনপির নেতা-কর্মীরা কী ধরনের আচরণ করতে পারেন, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডগুলো সেসব প্রশ্নের মুখোমুখি করেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড এবং দলীয় শৃঙ্খলার ব্যাপারে খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। গত ১১ আগস্ট দলের বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহানের পদ স্থগিত করার মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ শুরু হয়। সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় দীপ্ত টিভির সম্প্রচার কর্মকর্তা তানজিল জাহান হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য রবিউল আবিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্র জানিয়েছে, এ পর্যন্ত ১ হাজার ২৩ জন নেতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ৪৩৭ জনকে বহিষ্কার, ২৪ জনের পদ স্থগিত, ৫২৩ জনকে কারণ দর্শানোর নেটিশ, ৪ জনকে সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের নোটিশ ৩৫ জনকে সতর্ক এবং দেওয়া হয়েছে। যাদের মধ্যে রয়েছে দলের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ স্থায়ী কমিটির সদস্য, রয়েছে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকসহ বিভিন্ন স্তরের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা রয়েছেন। এর মধ্যে কারও কারও বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর, আবার অনেকের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে অভিযোগ পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

তাঁদের মধ্যে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ও এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ,সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ,  যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন,  ও বিলকিস জাহান, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম উল্লেখযোগ্য।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের দায়িত্বে থাকা জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘বিএনপির নামে কেউ কেউ দখলদারি, চাঁদাবাজি করতে পারে। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে বিএনপিসহ বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় চার শর বেশি বহিষ্কার করেছি, অনেকের পদ স্থগিত করা হয়েছে। কই মিডিয়ায় তো এসব লেখা হয় না। তারেক রহমানের নির্দেশে দখলদারত্বে যার নাম পাওয়া যাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

ঢাকা উত্তরের কমিটি বাতিল হলো কেন 

গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে হঠাৎ করেই ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটি বাতিল করে বিএনপি। কিন্তু ঠিক কী অভিযোগে এই কমিটি বাতিল করা হলো, তার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ জানানো হয়নি। দলের নেতারাও এ বিষয়ে কিছু বলছেন না।

এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়টির উল্লেখ করেছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা এতটুকু কোনো অভিযোগ পেলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন (ব্যবস্থা) নিয়েছি। আমরা ঢাকা সিটির উত্তরের কমিটি বাতিল করেছি। কেন করেছি, নিশ্চয়ই অভিযোগ আছে।’

নতুন নেতৃত্ব ঘোষণার মাত্র আড়াই মাসের ব্যবধানে এই কমিটি বিলুপ্তির পর ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক সাইফুল আলম (নীরব) ও সদস্যসচিব আমিনুল হককে নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা গুঞ্জন ও আলোচনা চলছে। কেউ বলছেন, সাইফুল আলমের বিরুদ্ধে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে দখল-অর্থ দাবির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গেছে। আবার কেউ বলছেন, সাবেক ফুটবলার আমিনুল হকের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম বন্দরের বিতর্কিত ব্যবসায়ী ও শেখ হাসিনা সরকারের বিশেষ সুবিধাভোগী হিসেবে পরিচিত তরফদার রুহুল আমিনের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগে কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

তরফদার রুহুল আমিন চট্টগ্রাম আবাহনী ক্লাবের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এবার বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি পদে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁর সমর্থনে মাঠে নামেন বিএনপির নেতা আমিনুল হক। যদিও ফেডারেশনের সভাপতি পদে বিএনপির আরেক নেতা ও ফুটবলার তাবিথ আউয়ালও একজন প্রার্থী। যিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিকবিষয়ক কমিটির সদস্য এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে গত দুবারের প্রার্থী। ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গেও তাঁর সম্পৃক্ততা দীর্ঘদিনের।

সাবেক ফুটবলার ও বিএনপি নেতা আমিনুল হক এ অভিযোগের ব্যাপারে  বলেন, ‘ একজন সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী তরফদার রুহুল আমিন ঠিক আছে, কিন্তু তিনি তো পদধারী কোনো আওয়ামী লীগের নেতা নন। আমার মাত্র এক দিনের পরিচয় তাঁর সঙ্গে। ক্রীড়াঙ্গনের লোকেরা আমাকে বলেছেন, উনি (তরফদার) হলে ফেডারেশনের ভালো হবে, ক্রীড়ার বিষয়ে তাঁর মানসিকতা, আগ্রহ আছে। যেহেতু আমরা ক্রীড়াঙ্গনকে দলীয়করণ করব না, সে জন্য আমি সমর্থন দিয়েছি। আর তাবিথ আউয়াল যে প্রার্থী হবেন, সেটা আমি জানতাম না।’

আমিনুল হক দাবি করেন, বিএনপির ঢাকা উত্তর কমিটির আহ্বায়কের (সাইফুল আলম) ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ গেছে। সে কারণেই কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

তবে সাইফুল আলম  বলেছেন, ‘আমার প্রতিপক্ষ আমিনুল হকেরা আগে থেকেই আমাকে চাঁদাবাজ বানানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি কোথায় চাঁদাবাজি করেছি, কার বাড়ি, দোকান দখল করেছি, তার কোনো প্রমাণ নেই।’ তিনিও দাবি করেন, ব্যবসায়ী তরফদার রুহুল আমিন কাছ থেকে বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা নিয়ে কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

এরই মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের কমিটি ছাড়াও চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা, কুড়িগ্রাম, কুষ্টিয়া, মাগুরা ও খুলনা জেলা কমিটি বাতিল করা হয়েছে।

অভিযোগ অনেকের বিরুদ্ধে

বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও কেউ কেউ বাদ পড়েছেন। এঁদের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় সহসাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম আজাদ, ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম, যুবদলের সভাপতি আবদুল মোনায়েমসহ (মুন্না) কিছু নেতার নাম মুখে মুখে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নারায়ণগঞ্জে রপ্তানিমুখী পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফকির গ্রুপের কাছে সুবিধা দাবি, আবু আশফাকের নেতৃত্বে বায়রা ভবনে ভাঙচুরের অভিযোগ রয়েছে। আর রফিকুল আলমের বিরুদ্ধে শান্তিনগরের ‘ইস্টার্ন প্লাস’ মার্কেটের কমিটি দখলসহ ঢাকা ও ফেনীর বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, আবদুল মোনায়েমের বিরুদ্ধে এক পরিবহন ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদা দাবির অভিযোগ উঠেছে। এসব ঘটনা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে জানানো হয়েছে বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।

এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনাটি ঘটে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পাঁচ দিন পর ১১ আগস্ট। ওই দিন বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলমের পক্ষ হয়ে রাজধানীর মতিঝিলে ইসলামী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে দখল নিতে যাওয়ার ঘটনায় নেতৃত্ব দেন যুবদলের ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্যসচিব রবিউল ইসলাম ওরফে নয়ন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সেদিন ইসলামী ব্যাংকের অন্তত ছয়জন কর্মী গুলিবদ্ধ হন। রবিউল ইসলামকে সেদিন মিছিলে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা যায়। এ ঘটনা সমালোচনার মুখে ফেলে বিএনপিকে।

অথচ সংগঠনটি দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের কাছে , আওয়ামীলীগ আমলের বিতর্কিত ব্যবসায়ী এস আলম গ্রুপের গাড়ি ব্যবহার করে নিজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ায় ব্যাখ্যা তলব করে। যদিও নেতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি গণমাধ্যমে সেভাবে উপস্থাপন না করায়  বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের অনেকে ক্ষোভ-অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম  বলেন, ‘অভিযোগ এলেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এর মধ্য দিয়ে আমরা সবাইকে একটা বার্তা দিচ্ছি যে দুর্বৃত্তায়ন চলবে না, অপরাধ করলে মেনে নেব না।’

আরও পড়ুন  ড. ইউনূস প্রভাবশালী বিশ্ব মুসলিমের তালিকায় 

1 thought on “বিএনপির ‘অবাধ্য’ নেতাদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *