ঘুমের জন্য বর্তমানে প্রতি রাতে ভালো ঘুম নিশ্চিত করার জন্য একেক মানুষ একেক নিয়ম মেনে চলেন। আবার অনেকেই ঘুম নিয়ে সচেতনতাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে। এইসব মানুষ ভাবেন, রাতের ঘুম শুধু ভালো হলেই হবে না, হতে হবে পরিপূর্ণ। রাতের ঘুম নিয়ে অতিসচেতন এই মানুষেরা অনলাইনে নিজেদের পরিচয় দিচ্ছেন ‘স্লিপম্যাক্সার’ হিসেবে। সম্প্রতি এমনই কয়েকজন স্লিপম্যাক্সিং সাক্ষাৎকার নিয়েছে মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস। স্লিপম্যাক্সারদের জীবনাযাপন কীভাবে তাঁদের ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে, প্রভাবগুলো ভালো নাকি মন্দ, এসব বিষয়ই উঠে এসেছে সাক্ষাৎকারে। শুরুতে বিষয়টি দারুণ মনে হলেও স্লিপম্যাক্সারদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্লিপম্যাক্সিংয়ের বেশ কিছু নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও দেখা গেছে।
স্লিপম্যাক্সিং কী?
মূলত স্লিপ অপটিমাইজেশন বা ঘুমের গুণগত মান বৃদ্ধি করার একটি ধারণা। রাতে পরিপূর্ণ ঘুমানোর অভ্যাস গড়ে তোলাকে বলা হচ্ছে স্লিপম্যাক্সিং (Sleepmaxxing)। ঘুম নষ্ট করতে পারে, এমন যেকোনো সমস্যা দূর করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করাও এর অংশ; অর্থাৎ পরিপূর্ণ ঘুমের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, তার সব কিছু নিশ্চিত করাই স্লিপম্যাক্সিংয়ের অন্যতম লক্ষ্য। এ কারণে স্লিপম্যাক্সাররা হরহামেশা গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতে সহায়ক বিভিন্ন জনপ্রিয় পণ্য ব্যবহার করেন। যেমন ম্যাগনেশিয়াম ফুট স্প্রে, মাউথ টেপ, চিন টেপ, স্লিপট্র্যাকার ইত্যাদি। স্লিপম্যাক্সিং-এর লক্ষ্য হলো ঘুমের সময়কে স্বাস্থ্যকর এবং পুনরুদ্ধারকারী হিসেবে ব্যবহার করা, যা দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য ও মনোবল বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে পারে।
ডেরেক অ্যান্টোসিক নামের একজন নিউইয়র্ক টাইমসে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তাঁর স্লিপম্যাক্সার হয়ে ওঠার গল্পটি তুলে ধরেছেন। যদিও তিনি এখন আর নিজেকে স্লিপম্যাক্সার বলে দাবি করেন না। ডেরেকের বয়স যখন বিশের কোঠায় তখন অনুধাবন করেন, তাঁর কিছু বদভ্যাস আছে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তখন থেকেই ডেরেক ঘুমের ব্যাপারে সিরিয়াস হতে শুরু করেন। ঘুমের উন্নতি ঘটানোর উপায় খুঁজতে খুঁজতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিটে এ–বিষয়ক একটি কমিউনিটি খুঁজে পান এবং সেখানে সক্রিয় হন। সেই কমিউনিটিতে যোগ দেওয়ার পর ডেরেক ভালোভাবে ঘুমানোর ব্যাপারে খুব আগ্রহী হয়ে উঠতে থাকেন। একটি জনপ্রিয় স্লিপ ট্র্যাকারের মাধ্যমে নিজের ঘুমের রেকর্ড রাখতে শুরু করেন।
নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গভীর ঘুমের সন্ধানে ডেরেকের এই যাত্রার অভিজ্ঞতা ছিল মিশ্র। ইয়ার প্লাগ, মাউথ টেপ, নেজাল ডাইলেটর ইত্যাদি ব্যবহার করে তিনি উপকার পেয়েছিলেন। কিন্তু বেড ফ্যান ব্যবহার করে খুব একটা উপকার পাননি। স্লিপ ট্র্যাকার ব্যবহার করে তাঁর ঘুমের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছিল। ডেরেকের ভাষ্যে, ‘আমি হঠাৎ হঠাৎ জেগে উঠতাম আর সঙ্গে সঙ্গে আমার স্কোর দেখতাম। ভাবতাম, আমার ঘুম কি ভালো হয়েছে?’
স্লিপম্যাক্সিং কি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে?
অর্থোসমনিয়া শব্দটি তুলনামূলক নতুন। এটি মূলত একটি মানসিক সমস্যা। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিভিন্ন স্লিপ ট্র্যাকার থেকে প্রাপ্ত ডেটা সংগ্রহ করতে থাকেন এবং ঘুমের ব্যাপারে হয়ে ওঠেন অতি খুঁতখুঁতে। অর্থোসমনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা স্লিপ ট্র্যাকার বেশিই মাথা ঘামাতে থাকেন এবং ঘুম নিয়ে এমন সব লক্ষ্য ঠিক করতে থাকেন, যেসব আদতে কখনোই তাঁর পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়।
অর্থরেক্সিয়া নামক আরেকটি মানসিক সমস্যা আছে,(‘অর্থো’ শব্দের মানে সরল, ‘সমনিয়া’ শব্দের অর্থ ঘুম) যেটিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা নিয়মমাফিক খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে অতিরিক্ত খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়ে ওঠেন। এজন্য অর্থোরেক্সিয়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই ঘুমের বিষয়ে সবার অহেতুক উদ্বেগ সৃষ্টিকারী মানসিক সমস্যাটির নামই অর্থোসমনিয়া।
২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, স্লিপ ট্র্যাকারের অতিরিক্ত ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। গবেষণাটিতে স্লিপ ট্র্যাকার ব্যবহারকারী তিনজনের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। স্লিপ ট্র্যাকারের ব্যবহার তাঁদের ঘুমের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলেছে, ব্যবহারকারীরা স্লিপ ট্র্যাকারের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেওয়া কোনো মতামতকে কীভাবে গ্রহণ করছেন, এসব বিষয় গবেষণায় বিশ্লেষণ করা হয়। অনিদ্রা রোগের চিকিৎসার জন্য বহুল প্রচলিত কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি ফর ইনসমনিয়া (সিবিটি-আই) নামক থেরাপির ক্ষেত্রে স্লিপ ট্র্যাকারের ব্যবহার সফলভাবে ব্যবহার করা সম্ভব কি না, এই প্রশ্নের উত্তরও গবেষণাটিতে খোঁজা হয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত গবেষকেরা সিদ্ধান্তে এসেছেন, সিবিটি–আইয়ের ক্ষেত্রে স্লিপ ট্র্যাকারের ব্যবহার নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। এসব ট্র্যাকারের কার্যকারিতার সপক্ষে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। তবু ঘুমের সমস্যায় ভুগতে থাকা লোকেরা এসব ব্যবহার করতে খুবই আগ্রহী। অনেক ব্যবহারকারীই মনে করেন, স্লিপ ট্র্যাকারে প্রদর্শিত ডেটা সত্যিই তাঁদের ঘুমের অভিজ্ঞতার সঙ্গে অনেক বেশি সংগতিপূর্ণ।
স্লিপম্যাক্সিং ধারণাটি বিশেষ করে আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা এবং মানসিক চাপের মধ্যে ঘুমের গুরুত্বকে তুলে ধরে। এটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ঘুমকে প্রাধান্য দেয়।
আরও পড়ুন শরীরে লবণ কম থাকলে কী কী হতে পারে?
1 thought on “স্লিপম্যাক্সিং কী, এর উপকারিতা কেমন?”