পাকিস্তানের আইএসআই

পাকিস্তানের আইএসআই গুপ্তচর সংস্থা

আন্তর্জাতিক
Spread the love

আইএসআই (ISI) বলতে মূলত পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (Inter-Services Intelligence)-কে বোঝানো হয়। এটি পাকিস্তানের অন্যতম প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা, যা মূলত সামরিক গোয়েন্দাবাহিনী হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানের আইএসআই-এর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে পাকিস্তানের জাতীয় সুরক্ষা রক্ষা করা এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করা। আইএসআই প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে, ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের এক বছরের মাথায়।

এটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি সংস্থা হলেও দেশের তিনটি সামরিক বাহিনী (নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনী) এবং অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার সহযোগিতায় কাজ করে।

পাকিস্তানের সরকারি গণমাধ্যম সম্প্রতি দেশটির অ্যাডজুটান্ট জেনারেল পদে কর্মরত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুহম্মদ আসিম মালিককে সামরিক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধানকর্তা হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে খবর প্রচার করেছে। নতুন প্রধান নিয়োগের পর সঙ্গেই এই গুপ্তচর প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে কাজ করে, সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হয়েছে।

একটু পিছনে ফিরে যাওয়া যাক। 

 ২০০৩ সালের পয়লা মার্চ রাওয়ালপিন্ডির একটা ঘর থেকে পাকিস্তানের এই গুপ্তচর সংস্থাটির প্রায় ১৫জন অফিসার গ্রেফতার করেছিলেন খালিদ শেখ মুহম্মদকে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো ত ৯/১১, অর্থাৎ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে যে হামলা হয়েছিল, সেই ষড়যন্ত্রে তিনি যুক্ত ছিলেন। ওই গ্রেফতারির ঘটনা নিয়ে সম্পূর্ণ তথ্য তুলে ধরতে সেদিনই সন্ধ্যায় ইসলামাবাদে আইএসআইয়ের সদর দফতরে ডাক পড়েছিল পাকিস্তানি ও বিদেশি সাংবাদিকদের।

আইএসআইয়ের কোনও একটি অভিযানের বিষয়ে সরাসরি বিদেশি সাংবাদিকদের এ ধরনের ব্রিফিং করার ঘটনা বিরল। ব্রিফিংয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের অনেকেই যদিও খালিদ শেখ মুহম্মদের গ্রেফতারির খবরটা আগে থেকেই জানতেন। এটাও তাদের অনেকের জানা ছিল যে খালিদ শেখকে রাওয়ালপিন্ডির একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যে বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল, সেটি আবার ছিল সুপরিচিত একটি ধর্মীয় পরিবারের বাড়ি। বাড়ির মালিক ছিলেন আব্দুল কুদ্দুস। তার মা ছিলেন জামায়েতে ইসলামির একজন সক্রিয় সদস্য।

জামায়েতে ইসলামির সঙ্গে আল কায়দা এবং অন্যান্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর সম্পর্ক নিয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনে আইএসআইয়ের উপ-মহাপরিচালককে প্রশ্ন করা হয়েছিল। সেই সময়ে আইএসআইয়ের উপ-মহাপরিচালক ছিলেন নৌবাহিনীর একজন অফিসার। তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে আল কায়েদা বা অন্য কোনও সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে জামায়াতে ইসলামির কোনও সম্পর্ক নেই।

পাক-মার্কিন গোয়েন্দা চুক্তি

ওই গ্রেফতারের পর থেকে আইএসআই একদিকে যেমন পাকিস্তানের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ এবং এফবিআইয়ের সঙ্গে যৌথ অভিযান পরিচালনা করে, আবার অন্যদিকে পাকিস্তানের ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলির সঙ্গেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে।

পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগির চুক্তি সই হয়েছিল ৯ /১১-র হামলার ঠিক পরেই, তবে বিষয়টি কখনই জনসমক্ষে আনা হয় নি। পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদানের সুফল দেখা গিয়েছিল আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের অবসানের পরে। সেই সময়ে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করছিল আর তাদের ধরার জন্য দুই দেশের গোয়েন্দারা তাদের পিছু ধাওয়া করতে সক্ষম হচ্ছিলেন।

কিন্তু সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলিকে দমনের কেন্দ্রবিন্দু যখন পরিবর্তিত হয়ে উপজাতীয় এলাকায় সরে যায়, তখন পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ব্যবহারিক ও রাজনৈতিক জটিলতা দেখা দিতে শুরু করে। একটি সমস্যা ছিল পাকিস্তান সরকার এবং উপজাতীয় অঞ্চলে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলির মধ্যে শান্তি চুক্তি। ওই চুক্তির ফলে স্থানীয় ও আল-কায়েদা সদস্যদের মধ্যে একটা ফারাক তৈরি হয়। ওয়াশিংটন যখন তালেবানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে এবং সেখান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের চুক্তি স্বাক্ষর করে, তখনও এই পাকিস্তান আর যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলির মধ্যে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল।

আইএসআইয়ের সাংগঠনিক কাঠামো

আইএসআই-এর মূল দায়িত্ব দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহারিক ও আদর্শগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। গুপ্তচর সংস্থাটির নাম – ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স -এর মধ্যেই সেটির মূল দায়িত্ব প্রতিফলিত হয়। বেসামরিক অফিসারেরাও আইএসআইয়ের উচ্চ পদে থেকেছেন, কিন্তু সংস্থাটির সাংগঠনিক কাঠামোতে তাদের বিশেষ আধিপত্য দেখা যায় না।

‘আইএসআই অব পাকিস্তান’-গ্রন্থে এ সংস্থাটির সাংগঠনিক কাঠামো তুলে ধরেছেন জার্মান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. হিন এইচ কিসলিং। কিসলিং ১৯৮৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে থেকেছেন। তিনি তার বইয়ে লিখেছেন, এটি একটি আধুনিক সংস্থা, যার কাজ মূলত গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা। আইএসআইয়ের সাংগঠনিক কাঠামোতে সেনাবাহিনীরই আধিপত্য থাকে, বিমানবাহিনী ও যদিও নৌবাহিনীর অফিসাররাও এই সংগঠনের অন্যত্ম গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

একজন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা বলেছেন, সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী বিভাগগুলি নিজেদের বাহিনীর প্রয়োজনমাফিক গোপন তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। আইএসআই এবং তিনটি সামরিক বাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা বাহিনী অনেক সময়ে একই ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে কারণ সবকটি গোয়েন্দা সংস্থাই সামরিক গতিবিধি আর শত্রুর ওপরে নজরদারি চালায়।

তবে সামরিক বাহিনীগুলির অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার তুলনায় আইএসআইকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে প্রভাবশালী ও সবচেয়ে শক্তিশালী গুপ্তচর সংস্থা বলে বিবেচনা করা হয়।

দেশের সবচেয়ে বড় গুপ্তচর সংস্থা হলেও সেখানে কত কর্মী আছেন, তা নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমে তেমন কোনও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। ওয়াশিংটন-ভিত্তিক ফেডারেশন অব আমেরিকান সায়েন্টিস্টের কয়েক বছর আগে চালানো এক তদন্তে  আইএসআইতে প্রায় ১০ হাজার অফিসার ও কর্মচারী রয়েছেন।

 কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স অপারেশন

সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএসআইয়ের সাংগঠনিক কাঠামো এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যাতে এটিকে এমন একটি গুপ্তচর সংস্থায় পরিণত হয়েছে, যারা মূলত কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দিকেই মনোনিবেশ করে থাকে। সামরিক বিষয়ের অভিধানে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের ব্যাখ্যা দিয়েছে : ‘বিদেশি সরকার,বিদেশি ব্যক্তি বা আন্তর্জাতিক সশস্ত্র গোষ্ঠী, বিদেশি সংস্থাগুলির দিকে পাল্টা নজরদারি চালানো।“ আরও জানায়, অন্যান্য গুপ্তচর সংস্থার গতিবিধি, ষড়যন্ত্র বা গুপ্তহত্যার মতো ঘটনার হাত থেকে বাঁচার মতো একটি গোয়েন্দা সংস্থার তৎপরতাও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মধ্যে পড়ে।

কিন্তু কেন আইএসআই কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বা পাল্টা গোয়েন্দাগিরির ওপরে এত বেশি নজর দেয়? পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার ফিরোজ এইচ খান । তার লেখা ‘ইটিং গ্রাস’ নামে একটি বইয়ে লিখেছেন, “সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তানের উপর হস্তক্ষেপ করে। এই বিষয়টি নিয়ে পাকিস্তানের তৃতীয় স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়া-উল-হক খুবই চিন্তিত ছিলেন। তার মনে হত যে ক্ষমতার নেশায় মত্ত এক বিশ্বশক্তি আমাদের দেশের দোরগোড়ায় হাজির হয়ে গেছে। “এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রশাসনের আর্থিক ও সামরিক সহায়তা যথেষ্টই ছিল বলে মনে করা হয় । তিনি এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে মার্কিন সহায়তা পাকিস্তানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াবে।

আরও পড়ুন হিজবুল্লাহ কারা, ইসরায়েলকে আক্রমণের স্বামর্থ্য কতটুকু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *