মীনা, রাজু, মিঠু

মীনা, রাজু, মিঠুরা কে কোথায়

বিনোদন
Spread the love

মীনা, রাজু, এবং মিঠু দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে জনপ্রিয় একটি অ্যানিমেটেড চরিত্রের গল্প থেকে এসেছে। তারা UNICEF-এর অধীনে তৈরি একটি শিক্ষামূলক সিরিজের চরিত্র, যা মূলত শিশুদের অধিকার, শিক্ষা, এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েশিশুদের অধিকার রক্ষার তাগিদ থেকে ‘মীনা’ কার্টুনের জন্ম। শুরুতে শুধু মেয়েশিশুদের অধিকারের কথা বললেও পথপরিক্রমায় সব শিশুরই অধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছে ‘মীনা’।

১৯৯৮ সালে ২৪ সেপ্টেম্বরকে ‘মীনা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে ‘মীনা’, ‘রাজু’ ও ‘মিঠু’র খোঁজ মিলল। এখন অনেক বড় হয়ে গেছে তারা আর ভীষণ ব্যস্তও। ‘মীনা’, ‘রাজু’, ‘মিঠু’ অবশ্য ওদের পর্দার নাম। পর্দার আড়ালে থাকা প্রমিতা গাঙ্গুলী, আবরার সাজিদ পাশা ও কামাল আহসানের কণ্ঠ শোনা গেছে পর্দার ‘মীনা’, ‘রাজু’ আর ‘মিঠু’র মুখে। সেটা অবশ্য ৩০ বছর আগে।

মীনা নিয়ে ভাবনা

সাউথ এশিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব রিজিওনাল কো–অপারেশন, সংক্ষেপে সার্ক, ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালকে মেয়েশিশুর দশক হিসেবে ঘোষণা করে। এ উপলক্ষে একটি অ্যানিমেটেড সিরিজ তৈরি করে দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়েদের আনন্দ ও উৎসাহ দিতে চেয়েছিল জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ)। মীনা নিয়ে ভাবনার শুরু তখন থেকেই।

মীনার স্রষ্টা

মীনা চরিত্রের স্রষ্টা হলেন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট ও চলচ্চিত্র নির্মাতা রাম মোহন। তিনি ইউনিসেফের সহযোগিতায় মীনা সিরিজ তৈরি করেন, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েদের অধিকার, শিক্ষা ও সমতার গুরুত্ব তুলে ধরা। মীনা চরিত্রটি ১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয় এবং এটি শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক কার্টুন সিরিজ হিসেবে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ১৯৯২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিমেশন স্টুডিও হান্না বারবারায় এখানে মীনা কার্টুনের প্রথম বেশ কয়েকটি পর্ব নির্মাণ করা হয়। তারপর বাংলাদেশ ও ভারতে মীনা কার্টুন তৈরি হয়েছে। জনপ্রিয় কার্টুন  নির্মাতা রামমোহন  ৮৮ বছর বয়সে মারা গেছেন ২০১৯ সালের অক্টোবরে।

রামমোহনকে বলা হয় ‘ফাদার অব ইন্ডিয়ান অ্যানিমেশন’ । ১৯৫৬ সালে খ্যাতনামা এই ভারতীয় চলচ্চিত্রের জগতে কাজ শুরু হয়েছিল। কাজ শুরু করেন প্রসাদ প্রোডাকশনের অ্যানিমেশন বিভাগের প্রধান হিসেবে। ১৯৭২ সালে নিজের প্রতিষ্ঠান রামমোহন বায়োগ্রাফিকস চালু করেন, যা বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে কাজ করেছিল। জাপানের ইউগো সাকোর সহযোগিতায় যৌথভাবে জনপ্রিয় অ্যানিমেটেড ছবি রামায়ণ: দ্য লিজেন্ড প্রিন্স রামা পরিচালনা করেছিলেন রামমোহন। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের চলচ্চিত্রেও কাজ করেছেন তিনি।

নানা দেশে ‘মীনা’

অবাক হলেও সত্য শুধু মীনা প্রচারিত হয়েছে বাংলা ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, নেপালি, ইংরেজিসহ কমপক্ষে ২৯টি ভাষায়। মীনার ১৬টি পর্ব বানানো হয় প্রথমে । সার্কভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এসব পর্ব প্রচার করা হয়। বর্তমানে মীনার ৩৭টি পর্ব রয়েছে। মীনার কার্টুন ছবি নিয়ে ২৩টি কমিক বইও বের হয়েছে। এসব বই পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।

এ নিয়ে দুই–একবার রাগারাগির মতো ঘটনাও ঘটেছে। ক্যাম্পাসে ‘মীনা’, ‘মীনা’ বলে খেপানোর কারণে নালিশও করেছেন শিক্ষকের কাছে। ‘আমি নিজেকে সত্যিই মীনা ভাবি। মীনার দর্শন ধারণ করি, কোনো অন্যায় বা বৈষম্য দেখলে যুক্তিসহকারে উত্তর না দিয়ে পারি না,’ বলেন প্রমিতা।

‘মীনা’য় আরও আছে

‘মীনা’ কার্টুনে মীনা, রাজু, মিঠু ছাড়া আছে আরও বেশ কয়েকটি চরিত্র। আছে ছোট বোন রানি, মা, বাবা, দাদি, ফুফু, গ্রামের দোকানদার, দোকানদারের ছেলে, স্কুলের বড় আপু রিতা, গ্রামের মোড়ল আর আছে মীনাদের গরু লালী ও ছাগল মুনমুন।‘মীনা’র উল্লেখযোগ্য কার্টুনমীনার উল্লেখযোগ্য কার্টুনগুলো হলো, ‘মুরগিগুলো গুনে রাখো’, ‘বুদ্ধিমতী মীনা’, ‘মীনা এল শহরে’, ‘মীনা কি স্কুল ছেড়ে দেবে’, ‘জীবন বাঁচানো’, ‘মীনার তিনটি ইচ্ছা’, ‘যৌতুক বন্ধ করো’, ‘বিয়ের বয়স হয়নি’, ‘মীনা ও দুষ্টু ছেলেরা’, ‘মেয়েদের যত্ন নাও’, ‘জাদুর পাথর’, ‘মীনার বন্ধু অনু’, ‘নতুন বন্ধু পিনুই’, ‘রূপকথার দেশে মীনা’, ‘পরির গল্প’ ও ‘মীনার যুদ্ধ’।

লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত সময় পার করছেন তিনি। অরণি স্কুলে প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় মীনার সঙ্গে যোগ দেয় রাজু তথা আবরার। স্কুলে এসেছিল ‘মীনা’ কার্টুনের দল। তখন অডিশন দিয়ে সুযোগ পেয়েছিলেন আবরার।

মীনা এখন গৃহবধু
‘ও রাজু, তুমি ইশকুলে যাইবা না?’ স্টুডিওতে প্রথম দিন এই সংলাপ দিয়েছিলেন প্রমিতা। ‘মীনা’ চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়া প্রমিতা গাঙ্গুলীকে গতকাল সোমবার বিকেলে পাওয়া গেল। শৈশবে কার্টুনপাগল মেয়েটির অভিনয়ে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। এখন আর তিনি বিনোদন জগতে নেই। তবে ‘মীনা’কে নিয়ে তাঁর অভিনয়ের স্মৃতিগুলো আজও জাগরূক। ছোটবেলায় কার্টুন দেখতে দেখতে চরিত্রের মতো কথা বলা রপ্ত করেছিলেন। নিজে নিজেই বলতেন সংলাপ। পরে এক আত্মীয়ের সূত্রে ‘মীনা’ কার্টুনের দলের সঙ্গে পরিচয়। বাবার হাত ধরে চলে যান ধানমন্ডির এক স্টুডিওতে।

২০২১ সাল পর্যন্ত মীনার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তত দিনে বড় হয়ে গেলেও কণ্ঠটা রপ্ত করেছিলেন বেশ, সমস্যা হয়নি। রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি শেষ করে পড়েছেন সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ ও ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। তড়িৎ ও ইলেকট্রিক প্রকৌশলের ডিগ্রি নিয়েছেন। পরে ইউল্যাব থেকে এমবিএ করেন। পূর্বে একটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তবে বর্তমানে পুরোদস্তর গৃহিণী, সন্তান নিয়ে পুরো ব্যস্ত। সন্তান একটু বড় হলে ভবিষ্যতে কিছু একটা করার ইচ্ছে ও পরিকল্পনা রয়েছে তার। বর্তমানে স্বামীর সঙ্গে গাজীপুরে রয়েছেন। স্কুলজীবন থেকেই তাঁকে ‘মীনা’ বলে ডাকত অনেকে। উচ্চ শিক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও ক্যাম্পাসে ‘মীনা’ ডাক শুনতে হয়েছে সবার কাছে। 

আবরার ‘রাজু’ সাজিদ

সারা গ্রামে ছোটাছুটি করা ‘রাজু’র কথা নিশ্চয়ই মনে আছে। মীনার ছোট ভাই। সব ধরনের দুষ্টুমিতে মীনাকে মাতিয়ে রাখে রাজু। ‘রাজু’র ভূমিকায় কণ্ঠ দিয়েছেন আবরার সাজিদ পাশা। গতকাল শেষবেলায় আবরার সাজিদকে পাওয়া গেল। টানা ১০ বছর মীনা দলে যুক্ত ছিলেন আবরার। টেলিভিশন ও বেতারে কণ্ঠ দিয়েছেন। পুরোনো বন্ধুদের অনেকেই এখনো তাঁকে ‘রাজু’ বলে ডাকেন। ‘মীনা’র সংলাপ শোনানোর জন্য অনুরোধ করেন। অবশ্য বর্তমানের বন্ধুরা তাঁর এই অধ্যায়ের কথা তেমন একটা জানত না। বর্তমানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে (বিইউপি) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত তিনি। আপাতত বিনোদন জগতে কাজের কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে সাংবাদিকতা বা লেখালেখিতে আগ্রহ আছে। সবই করবেন প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষ করে। সেদিক থেকে মূল লক্ষ্য, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ করা। স্বপ্ন—রাষ্ট্রদূত হবেন।

‘মিঠু’ই শুধু অভিনয়ে ব্যস্ত

আজও অনেকে শিশুদের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে যে সংলাপটি ব্যবহার করেন তা হল ‘আমার নাম মিঠু;যা এই কার্টুনের এই সংলাপই সবচেয়ে বেশি পরিচিত পায় শিশু কিশোরদের মাঝে। তিন মূল চরিত্রে একমাত্র মিঠুর কণ্ঠদানকারীই পেশাদার অভিনয়শিল্পী কামাল আহসান। যখন তাঁর সঙ্গে কথা হয়, তখন অনেকটা মজা করেই নিজের পরিচয় দেন ‘মিঠু’র মতো করে, ‘আমার আসল নাম কামাল আহসান।’

জনপ্রিয় মোটু–পাতলু সিরিজের ‘মোটু’, ‘জন’সহ তিনটি চরিত্রের কণ্ঠ তিনি দিয়েছেন। এসব চরিত্রের সংলাপও শোনালেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুস্তাফা মনোয়ারের জনপ্রিয় মনের কথা ধারাবাহিকে ‘বাউল’, ‘ষাঁড়’সহ বেশ কিছু চরিত্রের কণ্ঠও তাঁর। মীনা কার্টুনে কন্ঠ দেওয়া নিয়ে  এই অভিনেতা বলেন,সুবচন নাট্যদলে কাজ করতেন সেই সময়। পাশাপাশি ১৯৯০ সাল থেকে চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারে সঙ্গে পাপেট শো করতেন। ১৯৯৫ সালে ‘মীনা’ কার্টুনের কাজ শুরু করেন। ঢাকার বিভিন্ন স্টুডিওতে কণ্ঠধারণ হতো। পাখির কণ্ঠে কথা বলাটা একটা অন্য রকম অভিজ্ঞতা। সে সময় দিনের পর দিন টিয়া পাখির চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করতেন।

মীনা দিবসের এক অনুষ্ঠানে মঞ্চে এনে তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তখন উপস্থিত দর্শকের করতালি আর শুভেচ্ছায় বুঝতে পারেন, মানুষের মনে এখনো সেই কণ্ঠের সুবাদে তাঁদের জায়গা আছে। কোনো আয়োজনে কেউ যখন জানতে পারেন যে কামালই ‘মীনা’ এর রাজু তখন সবাই আবদার করলে কামালও তখন আনন্দ নিয়ে শোনান, ‘আমার নাম মিঠু’। মিঠুর চরিত্রে কণ্ঠ দেওয়াটা ছিল আমার জীবনের একটা বড় স্মৃতি।’ আগামী সময়েও অভিনয় পেশায় নিয়মিত হওয়ার ইচ্ছা কামাল আহসানের।

আরও পড়ুন নিপুণকে বিজয়ী করতে ১৭ বার ফোন করেন শেখ সেলিম 

 

1 thought on “মীনা, রাজু, মিঠুরা কে কোথায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *