ভাত আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকার একটি প্রধান উপাদান, বিশেষ করে এশিয়ার দেশগুলোতে। স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, ডায়েট পরিকল্পনা কিংবা বিভিন্ন খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের জন্য অনেকে ভাত খাওয়া কমিয়ে দেন বা পুরোপুরি বাদ দিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু, ভাত খাওয়া সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া শরীরের পুষ্টির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এখানে আমরা সেই পাঁচটি কারণ আলোচনা করবো, যেগুলোর জন্য ভাত খাওয়া বাদ দেওয়া উচিত নয়।
অপর দিকে ভাতের কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য বেশ উপকারী। এ জন্য আমাদের মতো অঞ্চলে দুপুরের খাবারে ভাত রাখতে হবে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, পরিমাণটা যেন দেড় থেকে দুই কাপের বেশি না হয়ে যায়, এমনটাই বলছিলেন পুষ্টিবিদ সাজিয়া মাহমুদ।
শক্তির প্রধান উৎস
ভাতে থাকা কার্বোহাইড্রেট শরীরের জন্য সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকর শক্তির উৎস। আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম করার জন্য শক্তি প্রয়োজন এবং ভাতের মধ্যে সহজপাচ্য কার্বোহাইড্রেট থাকে, যা শরীর সহজেই ভেঙে শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। বিশেষ করে যারা শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন, তাদের জন্য ভাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাতের কার্বোহাইড্রেট দ্রুত শরীরে গ্লুকোজে পরিণত হয়, যা শরীরের কোষগুলিকে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আমাদের দৈনিক ক্যালোরির একটি বড় অংশ কার্বোহাইড্রেট থেকে আসা উচিত। যদিও ডায়েট পরিকল্পনার সময় অনেকে কম কার্বোহাইড্রেট খেতে চান, তবে অতিরিক্ত কম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ করলে শরীরের শক্তি ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভাত একটি সুষম ও সহজে পাওয়ার মতো উৎস।
গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিন ও মিনারেল সরবরাহ করে
ভাত বিভিন্ন প্রকারের ভিটামিন ও মিনারেলের একটি ভালো উৎস। সাদা ভাত বিশেষত বি-কমপ্লেক্স ভিটামিন, যেমন- থায়ামিন, নিয়াসিন, রাইবোফ্লাভিন এবং ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ। এসব ভিটামিন শরীরের মেটাবোলিজম প্রক্রিয়া সচল রাখতে এবং স্নায়ুর কার্যক্রম সঠিকভাবে চালাতে সহায়তা করে। এছাড়া ভাত থেকে আমরা ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম, এবং আয়রনও পেয়ে থাকি, যা হাড় ও দাঁতকে শক্তিশালী রাখে, রক্তচলাচল উন্নত করে এবং রক্তের লোহিত কণিকা গঠনে সাহায্য করে।
এছাড়াও, বাদামী বা ব্রাউন রাইসের মধ্যে ফাইবার এবং আরো বেশি পরিমাণে পুষ্টি উপাদান থাকে। ব্রাউন রাইসের খোসার মধ্যে থাকা ফাইবার হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। সুতরাং, ভাত খাওয়া থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকলে এসব গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি উপাদান থেকে বঞ্চিত হওয়া সম্ভব।
হজমশক্তি উন্নত করতে সহায়তা করে
ভাত এমন একটি খাদ্য যা সহজেই হজম হয়। এটি পাকস্থলী এবং অন্ত্রের জন্য হালকা এবং হজমের পর শরীরে গ্যাস বা অস্বস্তি তৈরি করে না। সাদা ভাত হালকা হবার কারণে যেকোনো বয়সের মানুষ সহজেই এটি খেতে পারে, এমনকি যারা হজমের সমস্যায় ভুগছেন তাদের জন্যও এটি উপকারী। ভাত পানিশূন্যতা প্রতিরোধে সহায়তা করে এবং হজম প্রক্রিয়ায় পানি শোষণে সাহায্য করে।
বিশেষ করে যারা ডায়রিয়া, বমি বা পাকস্থলীর কোনো সমস্যা থেকে সেরে উঠছেন, তাদের জন্য ভাত খুবই উপকারী। এটি শরীরকে প্রাথমিকভাবে পুষ্টি সরবরাহ করে, হজমের উপর চাপ না ফেলে। অনেক ডায়েটারি ফাইবার থাকা খাদ্য হজমের জন্য বেশি সময় নিতে পারে, যেখানে ভাত দ্রুত হজম হয়ে শক্তি দেয়।
গ্লুটেন মুক্ত খাদ্য
গ্লুটেন হল এক প্রকারের প্রোটিন, যা গম, বার্লি, ওট এবং রাইয়ের মধ্যে পাওয়া যায়। অনেক মানুষের ক্ষেত্রে গ্লুটেন অসহিষ্ণুতা বা সিলিয়াক ডিজিজের মতো সমস্যা থাকতে পারে। এই সমস্যার জন্য তাদের গ্লুটেনমুক্ত খাদ্য গ্রহণ করতে হয়। ভাত একটি প্রাকৃতিক গ্লুটেনমুক্ত খাদ্য, যা গ্লুটেন অসহিষ্ণু মানুষের জন্য একটি নিরাপদ বিকল্প।
ভাতের সহজপাচ্য এবং গ্লুটেনমুক্ত বৈশিষ্ট্য একে সংবেদনশীল হজমশক্তির মানুষের জন্য আদর্শ খাদ্য করে তোলে। গ্লুটেনমুক্ত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে যেসব সমস্যা এড়ানো যায়, তার মধ্যে অন্ত্রের প্রদাহ, গ্যাস, ফোলাভাব এবং ডায়রিয়া উল্লেখযোগ্য। তাই যারা গ্লুটেনমুক্ত খাদ্য খুঁজছেন, তাদের জন্য ভাত একটি সুস্থ এবং নিরাপদ বিকল্প।
মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সাহায্য করে
ভাত খাওয়ার সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। ভাত খেলে আমাদের মস্তিষ্কে সেরোটোনিন উৎপন্ন হয়, যা মেজাজ ভালো রাখতে সহায়তা করে। সেরোটোনিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা মস্তিষ্কে প্রশান্তির অনুভূতি জাগিয়ে তোলে এবং উদ্বেগ কমায়। কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবারগুলো মস্তিষ্কে সেরোটোনিনের মাত্রা বাড়িয়ে আমাদের মানসিক চাপ কমাতে সহায়তা করে। বিশেষ করে শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক চাপের সময় ভাত খাওয়ার মাধ্যমে আমরা কিছুটা স্বস্তি অনুভব করতে পারি।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, সুষম কার্বোহাইড্রেট গ্রহণের ফলে আমাদের মনোযোগের মাত্রা বাড়ে এবং মানসিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। অতিরিক্ত ডায়েটিং বা ভাত খাওয়া সম্পূর্ণ বাদ দিলে শরীরে প্রয়োজনীয় কার্বোহাইড্রেটের অভাব ঘটে, যা মেজাজের পরিবর্তন ঘটাতে পারে এবং মানসিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
ভাত খাওয়া বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাদের সঠিকভাবে বুঝে নেওয়া উচিত যে ভাত আমাদের শরীরের জন্য কতটা প্রয়োজনীয়। শক্তি উৎপাদন থেকে শুরু করে পুষ্টি সরবরাহ, হজমশক্তি উন্নত করা, গ্লুটেনমুক্ত হওয়ার সুবিধা, এবং মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে ভাতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে কম ভাত খাওয়া বা সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়, তবে ভাত সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। সুতরাং, আমাদের উচিত সুষম ডায়েটের অংশ হিসেবে ভাতকে অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে আমরা সুস্থ ও সচেতন জীবনযাপন করতে পারি। ওজন নিয়ন্ত্রণ রাখতে ভাত যদি বাদই দিতে চান, তবে সেটা দুপুরে নয়। এর পরিবর্তে রাতে বা সকালে ভাত না খেয়ে অন্য খাবার খেতে পারেন।