বাংলাদেশে তিনটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের শিকার ত্বকী, তনু, ও সাগর-রুনি। যাদের নিয়ে দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচনা ও প্রতিবাদ হয়েছিল। কিন্তু এক অজানা কারণে সদ্য পদত্যাগকারি শেখ হাসিনার আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে আলোচিত সাগর-রুনি,ত্বকী আর তনুর হত্যার বিচার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়নি,গ্রেফতার হয়নি উল্লেখ যোগ্য কোন আসামী। এই তিনটি হত্যাকাণ্ডই বাংলাদেশের বিচারহীনতার চিত্র ও বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে বড় প্রশ্ন তুলে ধরেছে। বর্তমানে অর্ন্তবর্তী সরকারের আমলে এই তিন পরিবারসহ দেশের সাধারণ মানুষ অপেক্ষায় রয়েছে,হত্যা যুক্ত সবাইকে বিচারের সামনে নিয়ে আসা।
ত্বকী
রফিউর রাব্বি অসহনীয় এক ভার বয়ে বেড়াচ্ছেন। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশকেই পৃথিবীতে বেশি ভারী মনে হয়। গত সাড়ে ১১ বছর এই ভার নিয়ে চলছে বাবা রফিউর রাব্বি।
তাঁর সন্তানের নাম তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। চাষাঢ়ার এবিসি ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষার্থী ছিল। ২০১৩ সালের ৭ মার্চ এ লেভেল পরীক্ষার ফলাফলে পদার্থবিজ্ঞানে ৩০০ নম্বরের মধ্যে ২৯৭ পেয়েছিল ত্বকী, যা সারা দেশে সর্বোচ্চ। এ ছাড়া ও লেভেলেও সে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন পরীক্ষায় দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিল। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ নারায়ণগঞ্জে অপহৃত হন। দুই দিন পর, শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
এ রকম একজন মেধাবী তরুণের সঙ্গে কারও বিরোধ ছিল না। তারপরও কেন তাঁকে খুন করা হলো? নারায়ণগঞ্জের গডফাদার হিসেবে যাঁদেরকে সবাই চেনে, ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বি সেই ওসমান পরিবারের সন্ত্রাস ও দখলবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন
নাগরিক কমিটির নেতা হিসেবে তিনি সেখানকার নাগরিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করেছেন, এখনো করছেন। নাগরিক আন্দোলনের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন থাকলেও বেঁকে বসে ওসমান পরিবার। তারা তখন ভীষণ ক্ষমতাধর।এরপরই ঘটে ত্বকী হত্যার ঘটনা। কী বীভৎস ও নৃশংস ছিল সেই হত্যাকাণ্ড!
৮ মার্চ রাতেই ত্বকীর বাবা বাদী হয়ে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ ধারায় আসামি অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে একটি হত্যা মামলা করেন এবং ১৮ মার্চ জেলা পুলিশ সুপারের কাছে ত্বকী হত্যার জন্য তিনি শামীম ওসমান ও তাঁর ছেলে অয়ন ওসমানসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে একটি অবগতিপত্র দেন। পুলিশের তদন্তে অগ্রগতি না হওয়ায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে র্যাব ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তভার গ্রহণ করে।
ওই বছরের ৭ আগস্ট র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তা শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরী ওসমানের মালিকানাধীন ‘উইনার ফ্যাশন’-এ অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা জিনস প্যান্ট, পিস্তলের বাঁট ও ইয়াবা সেবনের সরঞ্জামাদিসহ বিপুল পরিমাণ সামগ্রী উদ্ধার করে। অভিযানের সময় অফিসের দেয়াল, সোফা, আলমারিসহ আসবাবপত্রে অসংখ্য বুলেটের দাগ পাওয়া যায়। নারায়ণগঞ্জে অন্যতম টর্চার সেল ছিল উইনার ফ্যাশন।
বর্তমানে আটক র্যাবের তৎকালীন অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি) কর্নেল জিয়াউল আহসান সেই সময় গনমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘ ত্বকী হত্যা তদন্তে সন্দেহভাজন হিসেবে ওসমান পরিবারের সদস্য আজমেরী ওসমানসহ ১১ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এছাড়া বাকী ১০ জন হলেন সুলতান শওকত ওরফে ভ্রমর, কালাম শিকদার, অপু, রাজীব, কাজল, শিপন,মামুন, তায়েবউদ্দিন ওরফে জ্যাকি, জামশেদ হোসেন ও ইউসুফ হোসেন ওরফে লিটন। যেকোনো দিন এই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’ কিন্তু ২০২৪ সালেও অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।
ত্বকী হত্যার এক বছর পর নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা ঘটে। সেই মামলার বিচারকাজও চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। অথচ ত্বকী হত্যার তদন্তকাজই শেষ হয়নি। কারণ, ওসমান পরিবারকে রক্ষায় আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায় হস্তক্ষেপ।গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পালাবদলের পর আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকাজে গতি এসেছে। সাবেক এমপি নাসিম ওসমানের ছেলে আজমেরী ওসমানের গাড়িচালক জামশেদ শেখকে (৩৬) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এর আগে গ্রেপ্তার হন সাফায়েত হোসেন শিপন, মামুন মিয়া ও কাজল হাওলাদার। বর্তমানে তাঁদের র্যাব হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
সম্প্রতি সন্ত্রাসবিরোধী ত্বকী মঞ্চের উদ্যোগে জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা বলেছেন, সাবেক স্বৈরাচারী সরকার বিচারপ্রক্রিয়া নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করেছে। এখন বাধা নেই। দ্রুত বিচারকাজ শেষ করা হোক। ত্বকী হত্যার ঘটনায় এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া পাঁচজনের দুজন ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে অপরাধ স্বীকার করে। জামিনে মুক্ত হওয়ার পর থেকে পলাতক।
তনু হত্যা
সোহাগী জাহান তনু ছিলেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালের ২০ মার্চ রাতে কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাসের পাওয়ার হাউসের অদূরের জঙ্গল থেকে সোহগী জাহান তনুর লাশ উদ্ধার করা হয়। তনুর হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনার পর দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, বিশেষত নারীদের নিরাপত্তা এবং বিচারহীনতার বিরুদ্ধে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর বাবা কুমিল্লা সেনানিবাসের একজন অফিস সহকারী। খুবই কম বেতনে চাকরি করতেন। তনু কলেজে পড়ার পাশাপাশি পরিবারকে সহায়তা করার জন্য টিউশনি করতেন।
তনু পড়তেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে। ভালো গান গাইতেন। নাট্যদলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সাড়ে আট বছর পরও কি জানা গেল, তনু হত্যার সঙ্গে কারা জড়িত ছিল? সেনা নিবাসের নিশ্ছিদ্র পাহারায় কারা খুন করল? কীভাবে মেয়েটি খুন হলেন?
মামলার তদন্তভার প্রথমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) থাকলেও,পরবর্তীতে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) দায়িত্ব স্থানান্তর করা হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে পিবিআইও এই মামলার কোনো কিনারা করতে পারেনি। তনুর মা আনোয়ারা বেগম প্রথম আলোকে আক্ষেপ করে বলেন, ‘গরিবের কোনো বিচার নেই। এ বছর তনুর বাবার চাকরি শেষ হবে। আমরা এখান থেকে চলে যাব। মেয়ে হত্যার বিচার না পেয়েই এক বুক দুঃখ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।’
সন্তানহারা একজন মা যে মনের দিক থেকে কত শক্ত থাকতে পারেন, তা আনোয়ারা বেগমকে দেখলে বোঝা যায়। নানা মহলের ভয়ভীতি উপেক্ষা করে তিনি তনু হত্যার বিচারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, সমাবেশে কথা বলেছেন। তিনি জানেন সন্তানকে আর ফিরে পাবেন না। কিন্তু তাঁর দুটি চাওয়া- তনুকে যারা খুন করেছে, তাদের শাস্তি এবং ভবিষ্যতে আর কারও সন্তান যেন অপঘাতের শিকার না হয়।
ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার বিদায় নিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারকেরা সমাজের সর্বস্তরে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন। কিন্তু তনু, ত্বকী ও সাগর-রুনি হত্যার বিচার না করে সেটা কি সম্ভব? আমরা আশা করব, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের স্বার্থেই সরকার এসব হত্যার তদন্তকাজ দ্রুত শেষ করে বিচারের পথ উন্মুক্ত করবে। অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করবে।
সাগর-রুনি হত্যা
সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনি ছিলেন সাংবাদিক দম্পতি। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সারোয়ার ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি নিজেদের বাসায় খুন হন। ১৬ বছর পার হলেও তদন্তকাজ শেষ করতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ১১১ বারের মতো পিছিয়েছে। পরবর্তী তারিখ ১৫ অক্টোবর দিন ঠিক করেছেন আদালত।
সাগর-রুনি হত্যার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন সাংবাদিকদের ঘোষণা দিয়েছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে গ্রেফতার করা হবে। এই মামলাইয় ওই থানার এক উপপরিদর্শক (এসআই) কে প্রথম তদন্তের দায়িত্ব দিলেও,চার দিন পরই চাঞ্চল্যকর এই হত্যা মামলার তদন্তভার পরিবর্তন করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয় ডিবি। হাইকোর্টের নির্দেশে একই বছরের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর থেকে কেবল তারিখ বদল হয়, তদন্ত কাজ শেষ হয় না।
২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি লিখিতভাবে র্যাব আদালতকে জানিয়েছিল, সাগর-রুনির বাসা থেকে জব্দ করা আলামতের ডিএনএ পর্যালোচনায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষের উপস্থিতি মিলেছে। অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষকে শনাক্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ইনডিপেনডেন্ট ফরেনসিক সার্ভিসেস (আইএফএস) ল্যাবে ডিএনএ পাঠানো হয়েছে।সেখান থেকে ছবি প্রস্তুতের চেষ্টা চলছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ডিএনএ ল্যাবের ফলাফল জেনেছে র্যাব। তবে অজ্ঞাতপরিচয় দুজনের ডিএনএ থেকে ছবি তৈরির সন্তোষজনক ফল আসেনি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আটজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বর্তমানে দুজন জামিনে, বাকি ছয়জন কারাগারে আছেন।