বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি (বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল) গণঅভ্যুত্থান বা গণজাগরণ থেকে কয়েকবার রাজনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছে। গণঅভ্যুত্থান সাধারণত সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের অসন্তোষ এবং সরকারের অপদার্থতা বা স্বৈরতান্ত্রিক আচরণের কারণে ঘটে থাকে। বিএনপি, প্রতিষ্ঠার পর থেকে, জনগণের এই অসন্তোষকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগিয়ে একাধিকবার সুবিধা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে তিনটি বড় গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনীতির বাঁক বদল ঘটেছে, তার সবগুলোতে দৃশ্যত লাভবান হয়েছে বিএনপি। এই তিনটি ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫ সাল, ১৯৯০ সাল এবং ২০২৪ সালে।
এসব গণঅভ্যুত্থানের একটির মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছেন, আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের পরে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে এবং আরেকটির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আওয়ামী লীগ অত্যন্ত নেতিবাচক হিসেবে জনগণের কাছে প্রতিভাত হয়েছে। সে সুযোগ বিএনপি পেয়েছে।
বাংলাদেশের প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ জানান, গণঅভ্যুত্থানে বা জনরোষের ফলে যখন সরকার পরিবর্তন হয়েছে, সেই সময়ই বিএনপি রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলেছে।
সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পূর্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সর্বস্তরের মানুষের মনে মারাত্মক অসন্তোষ ছিল। একদলীয় শাসন ব্যবস্থা, যেটি ‘বাকশাল’ হিসেবে পরিচিত, প্রবর্তনের মাধ্যমে মুজিব-বিরোধী মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে।
সেই সময় দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ খুবই নেতিবাচক হিসেবে সচেতন মানুষের মনে প্রভাব সৃষ্টি হয়েছিল,” শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৫ই আগস্ট হত্যার পর তখন বাংলাদেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল। সেই শুন্যতা পূরণের জন্য ‘বিশ্বাসযোগ্য ও জনপ্রিয়’ কোন রাজনৈতিক কোন দল ছিলনা। আর তখন যেসব রাজনৈতিক দল ছিল, তাদের জনপ্রিয়তা ততটা শক্তশালী ছিল না। তখন ক্ষমতা গ্রহণ করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ, যিনি বঙ্গবন্ধুরই আওয়ামী লীগের অন্যতম কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন।
তবে সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে জিয়াউর রহমান সেনানিবাসের বাইরেও অনেকের কাছে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৩রা নভেম্বর মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়। খালেদ মোশাররফের এই অভ্যুত্থানকে ভারতীয় আধিপত্যবাদের একটি ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে মুজিব-বিরোধীরা।
৭ই নভেম্বর দেশের বিভিন্ন সেনানীবাস থেকে সৈন্যরা ঢাকায় এসে পৌঁছায়,যাদের সাথে স্বতঃ:স্ফূর্তভাবে হাজার হাজার সাধারণ জনতা যোগ দেয়। এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিল তৎকালীন সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাসদ নেতা কর্নেল আবু তাহের। প্রধানত তার পরিকল্পনায় জাসদের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এই অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়।
লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, তখন অনেকের ্মনে ধারণা হয়েছিল যে, ভারতের সহায়তা নিয়ে আওয়ামী লীগ হয়তো আবার ফিরে আসতে পারে। কিন্তু সেই আশঙ্কা কে টপকিয়ে ৭ই নভেম্বর কর্নেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে সিপাহী-জনতা বিদ্রোহ করে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে।
এরপর বন্দীদশা থেকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, ৭ই নভেম্বর বিদ্রোহ না হলে জিয়াউর রহমান রাজনীতিতে কতটা আসতেন কিংবা আসলেও কতটা সফল হতেন সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ৭ই নভেম্বরের পরে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালিত হতে থাকে জিয়াউর রহমানের ইশারায়।
কর্নেল আবু তাহের যে আশায় জিয়াউর রহমানকে পাশে পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু জিয়াউর রহমান মুক্ত হয়ে অন্যকিছুর ইংগিত দিলেন। দৃশ্যপটের সামনে চলে আসেন জিয়াউর রহমান এবং আড়ালে যেতে থাকেন কর্নেল তাহের। খন্দকার মোশতাক ক্ষমতাচ্যুত হবার পরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তিনি প্রেসিডেন্ট থাকলেও ক্ষমতা পরিচালিত হতো ক্যান্টনমেন্ট থেকে জিয়াউর রহমানের নির্দেশনায়।
কর্নেল তাহেরসহ ১৭ জনকে ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে সামরিক আদালতে গোপন বিচার করা হয় এবং কর্নেল আবু তাহেরকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। ১৯৭৬ সালের নভেম্বর মাসে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ থেকে সরে যান আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তখন জিয়াউর রহমানের হাতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব দেয়া হয়।
এর পাঁচ মাসের মাথায়, অর্থাৎ ১৯৭৭ সালের এপ্রিল মাসে আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব জিয়াউর রহমানের কাছে দিয়ে পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি হবার দেড় বছরের মধ্যে রাজনৈতিক দল গঠন করেন জিয়াউর রহমান।
মূলত,গণঅভ্যুত্থানের ধারাটাকে আওয়ামী লীগের মতো বড় দলের বিরোধিতার মাধ্যমে জিয়াউর রহমান বা বিএনপি তাদের দিকে নিতে পেরেছিল, ।
১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান
১৯৮০’র দশকে তৎকালীন সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতা থেকে সরানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও বিএনপি আন্দোলন করে। তাদের সাথে অন্যান্য রাজনৈতিক দলও ছিল। কিন্তু দেখা গেল, এরশাদের পতনের পরে ১৯৯১ সালে বাংলাদেশে যখন প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি।
প্রসঙ্গত, ১৯৮৬ সালে এরশাদের শাসনামলে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করার কারণে জনগণের মধ্যে তাদের নিয়ে একটি নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হয়। তখন এরশাদ-বিরোধী বড় রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছিল যে স্বৈরাচার সরকারের আমলে কোন নির্বাচনে তারা অংশ নেবে না। কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।
নির্বাচনে অংশ নেবার ব্যাপারে এইচএম এরশাদ সরকারের সাথে তাদের একটি সমঝোতা হয়েছিল বলে জানা যায়। তখন এরশাদ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী ছিলেন মওদুদ আহমদ, যিনি পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন। মওদুদ আহমদ ২০২১ সালে মারা যান।
“এরশাদের পতনের পর এসব বিষয় বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা দিয়েছিল । যার ফলে ১৯৯১ সংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে ক্ষমতায় আসে খালেদা জিয়ার বিএনপি ।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, একদিকে এরশাদের সাথে সমঝোতা করে আওয়ামী লীগ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে, অন্যদিকে জেনারেল এরশাদ বিএনপিকে ভাঙার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং বিএনপি থেকে একটি অংশকে বের করে এনেছিলেন।
“খালেদা জিয়া নেতা হয়েছিলেন এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। তিনি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী হিসেবে নেতা হন নাই। জিয়ার রহমানের স্ত্রী হিসেবে তিনি দলে এসেছিলেন, কিন্তু নেতা হয়েছিলেন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এই ফসলটা তিনি ঘরে তুলেছিলেন ১৯৯১ সালে,” বলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান
২০২৪ সালের ৫ই অগাস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতা ছেড়ে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে যে দুটো রাজনৈতিক দল এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে লাভবান হয়েছে তারা হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠ স্বয়ংক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের দখলে চলে গেছে।
আওয়ামীলীগের আমলে মামলায় জর্জরিত থাকা বিএনপি নেতারা-কর্মীরা এখনই আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা অনেক কিছুই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন বা দখল করেছেন। ৫ই অগাস্টের পরে বেশ দ্রুততার সাথে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে মুক্তির আদেশে স্বাক্ষর করের রাষ্ট্রপতি। এরপর বিএনপির বেশ কিছু সিনিয়র নেতা জেল থেকে দ্রুত ছাড়া পান। অনেকের বিরুদ্ধে কিছু মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন।
লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি নেতা তারেক রহমানের বক্তব্য বিবৃতি শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে প্রচার করা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনে তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ে বিএনপি নেতা-কর্মীদের এখন আর পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে না। এসব কিছু বিএনপিকে তাৎক্ষনিকভাবে রাজনৈতিক সুবিধা দিয়েছে।
গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলকে ‘ফ্যাসিবাদের’ তুলনা করেছে বিএনপি। ৫ই অগাস্ট শেখ হাসিনার পতন ও ভারতে পালিয়ে যাবার পরে বিএনপির দেয়া ‘ফ্যাসিবাদ’ তকমা অনেকেই ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেন, আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সাল এবং ২০২৪ সালে জনগণের সামনে নেতিবাচক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এর রাজনৈতিক সুবিধা খুব স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে গেছে। যার ফলে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পরিবর্তে মানুষ আবার বিএনপিকেই ক্ষমতায় দেখতে পাচ্ছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের বাইরে যদি আরেকটি কার্যকরী শক্তি থাকতো তাহলে বিএনপি হয়তো বা এই সুবিধা পেতো না। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি-আওয়ামী লীগের কোন ফারাক নেই।
তবে বর্তমানে বাংলাদেশে বিএনপিকে চ্যালেঞ্জ করার মতো নতুন অন্য কোন রাজনৈতিক শক্তিশালী দল গঠিত হলে নির্বাচনের ফলাফল কোন দিকে যাবে তা এখনই বলা মুশকিল।