কি কি পরিবর্তন আসলো।

শেখ হাসিনা সরকারর পতনের এক মাস: কতটুকু পরিবর্তন হলো।

বাংলাদেশ
Spread the love

আজ ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রোজ বৃহস্পতিবার। আজ থেকে এক মাস আগে ৫ই আগস্ট রোজ সোমবার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। ছাত্র জনতার গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। এরপর ৮ ই আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয় ডঃ মোঃ ইউনুস এর হাতে। তাকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠন করা হয়। 

যেহেতু এটি একটি গণঅভ্যুত্থান ছিল তাই নতুন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই বিভিন্ন সংস্কার কাজে হাত দেওয়ার প্রয়োজন হয়। গত এক মাসে কি কি পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করতে পারলাম সেগুলো তুলে ধরবো আজকের এই আলোচনায়। 

 

পদত্যাগের ছড়াছড়ি

প্রায় সাড়ে পনেরো বছর ধরে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামীলীগ সরকার। বাংলাদেশের প্রায় সকল সেক্টরে দলীয়করণ হয়ে গিয়েছিল। যার সত্যতা দেখা যায় শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সরকারি, আধা-সরকারি এমনকি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের ছড়াছড়ি দেখা যায়। সকলেই যে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন বিষয়টি এমন নয় অনেককে জোরপূর্বক অপমান অপদস্ত করে চাপের মুখে পদত্যাগ করানো হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ উপাচার্য, প্রক্টর সহ শীর্ষ বিভিন্ন পদের ব্যক্তিরা দায়িত্ব ছেড়েছেন। এগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ হলেও বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনো নিয়োগ বাকি রয়েছে। বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রব তালুকদার পদত্যাগ করেছেন। পাশাপাশি দেপুটি গভর্নর সহ আরো চারজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে সাদা কাগজে লিখিত দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। নতুন গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুরকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ইসলামী ব্যাংক সহ অন্তত আরো আটটি ব্যাংকের আগের পর্ষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন পর্ষদ গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, ঢাকা ওয়াসা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সহ এ সকল প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ ব্যক্তিরা পদত্যাগ পত্র জমা দিয়েছেন।

 

পুলিশকে থানায় ফেরানো 

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে জনগণের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি যে বাহিনীটিকে ব্যবহার করা হয়েছিল তা হল পুলিশ বাহিনী। তাই ৫ ই আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনী কার্যত ভেঙে পড়ে। নজিরবিহীনভাবে বিভিন্ন থানায় হামলার ঘটনা ঘটে। অসংখ্য পুলিশ থানা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশ পুলিশ এসোসিয়েশনের মতে প্রায় ৪৫০ টি থানায় আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। অসংখ্য থানা থেকে অস্ত্র মালামাল লুট করা হয়েছে, থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনী তাদের দায়িত্বে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সাহস হারিয়ে ফেলে। তারা বিভিন্ন সংস্কার দাবি তুলে বসে। তারা কর্মে যোগদানের অব্যাহতি দেয়। সমস্যার সমাধানের জন্য উদ্যোগ নেন ডঃ মোঃ ইউনুসের সরকার। এ সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ছিলেন উপদেষ্টা এম শাখাওয়াত হোসেন। তিনি পুলিশের দাবি পূরণের আশ্বাস দেন। তিনি পুলিশের কর্মে যোগদানের জন্য সময়সীমা বেধে দেন। তিনি উল্লেখ করেন ১৫ ই আগস্ট এর মধ্যে কাজে যোগ না দিলে তিনি আর ওই চাকরি করতে  আগ্রহী নন বলে ধরে নেওয়া হবে। এই ঘোষণা দেওয়ার পরে ১১ই আগস্ট কর্মবিরতি প্রত্যাহার করে থানায় যোগদান করেন পুলিশ সদস্যরা। এ সময় পুলিশের লোগো এবং পোশাক পরিবর্তনেরও দাবি উঠেছিল। যদিও তা আর বাস্তবে রূপ নেয়নি।

 

প্রশাসনিক পরিবর্তন 

অন্তবর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ব্যাপক রদবদল হয়েছে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে। অনেক নতুন কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে পাঠানো হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছিলেন যে সব শীর্ষ কর্মকর্তারা তাদের মধ্যে অনেকেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেনকে। চাকরি হারাতে হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মোঃ রহমাতুল মুমিনকে। তার জায়গায় আব্দুর রহমান খান কে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ আল মামুনের চুক্তি বাতিল করে নতুন পুলিশ মহাপরিদর্শক করা হয় অতিরিক্ত আইজিপির দায়িত্বে থাকা মোঃ ময়নুল ইসলামকে। বাধ্যতামূলকভাবে অবসরে দেওয়া হয়েছে পুলিশ কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার মোঃ মনিরুজ্জামান সহ আরো বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে।

 

বিচার বিভাগের পরিবর্তন 

বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে। ১০ আগস্ট পদত্যাগ করতে বাধ্য হন আওয়ামীলীগ আমলের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। বৈষম বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে তাকে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হয়। তার স্থলে নতুন বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন সৈয়দ রিফাত আহমেদ। আপিল বিভাগের আরো চারজন বিচারপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ এম আমিন উদ্দিনের পরিবর্তে সুপ্রিমকোর্টের জ্যৈষ্ঠ আইনজীবী মোঃ আসাদুজ্জামানকে অ্যাটর্নি জেনারেল করা হয়। এছাড়াও আগের নিয়োগ বাতিল করে সারাদেশে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অটর্নি জেনারেল পদে ২২৭ জন আইনজীবীকে নতুন করে নিয়োগ দিয়েছে এই অন্তর্বর্তী সরকার। 

 

সাজা বাতিল ও নতুন মামলা 

সরকার পতনের পরে অনেক সাজা বা মামলার রায় বাতিল করা হয়েছে। বেড়েছে নতুন ধরনের মামলার সংখ্যা। আওয়ামী লীগ শাসনামলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলার আসামি ছিলেন ডঃ মুহাম্মদ ইউনুস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরজাহান বেগম। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের আগের দিন তাদের সাজা বাতিল করে দেওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে আরো অন্য যে মামলা গুলো ছিল সেগুলো থেকেও তাদেরকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় সাত বছরের জন্য জেল দেওয়া হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়াকে। সরকার পতনের একদিন পর রাষ্ট্রপতি তার সাজা মওকুফ করে দেন এবং মুক্তি দেওয়া নির্দেশ দেন। তার বিরুদ্ধে আরো যে মানহানির মামলা গুলো ছিল সেখান থেকেও খালাস দেওয়া হয় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যে সকল ছাত্রকে অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাদেরকে মুক্তি দেওয়া হয়। বিএনপি এবং জামায়াত দল গুলোর শীর্ষ নেতা সহ আরো অসংখ্য নেতা কর্মীদের মুক্তি দেওয়া হয়। অন্যদিকে মানবাধিকার লঙ্ঘন সহ নানা ধরনের দুর্নীতি ও হত্যার অভিযোগে বিভিন্ন ধরনের মামলা দেওয়া হয় আওয়ামীলীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে শতাধিক মামলা করা হয়েছে যেগুলোর মধ্যেই বেশিরভাগই হত্যা মামলা। মামলা হয়েছে সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ, শেখ রেহেনা সহ আওয়ামীলীগ সভাপতি পরিবার ও অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের বিরুদ্ধে। সাবেক মন্ত্রী এমপি সহ প্রায় সকল আওয়ামীলীগ শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হতে দেখা গেছে। ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন অনেক প্রভাবশালী এমপি মন্ত্রী। শেখ হাসিনাসহ আগের সরকারের মন্ত্রী এমপিদের কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করা হয়েছে। 

 

গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠন 

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে অসংখ্য মানুষকে গুম করা হয়েছিল। গুম হওয়া অনেক ব্যক্তির খোজ মিলছে সরকার পতনের পর। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একজন হলেন জামায়াত ইসলামের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে সাবেক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল আব্দুল্লাহিল আমান আজমি। তিনি প্রায় দীর্ঘ আজ ৮ বছর পর আয়না ঘর থেকে মুক্ত হলেন, তাকে ২০১৬ সালে গুম করা হয়েছিল। এরকম প্রায় ৭০০ গুমের অভিযোগ ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। সরকার পতনের পর গুম হওয়া অনেক ব্যক্তি ফিরে আসলেও অনেক ব্যক্তি এখনো ফিরে আসেননি। ফিরে আসা আরো একজন ব্যক্তি হলেন মাইকেল চাকমা যিনি চট্টগ্রাম কেন্দ্রীক একটি রাজনৈতিক দল ইউপিডিএফ এর সংগঠক, তিনি পাঁচ বছর পর মুক্তি পেয়েছেন। গুমের বিষয় নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এই তদন্ত কমিশনের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। এই কমিশনের কাজ হল গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে তথ্য খুঁজে বের করা।

 

শিক্ষা খাতে পরিবর্তন 

সরকার পতনের পরে শিক্ষা খাতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় এইসএসসি পরীক্ষা বন্ধ করা হয়েছিল ১৮ জুলাই। অন্তর্বর্তী সরকার ১১ সেপ্টেম্বর থেকে বাকি পরীক্ষা গুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। কিছু পরীক্ষার্থী সচিবালয়ে ঢুকে এ বিষয়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে। ফলে অনিবার্য কারণ দেখিয়ে ২০শে আগস্ট এইসএসসির বাকি বিষয়ের পরীক্ষা গুলো বাতিল করা হয়। চলতি বছর নবম শ্রেণীতে বিভাগের যে বিভাজন ছিল তা তুলে দিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সেই ব্যবস্থায়  সংস্কার এনে আবারও বিজ্ঞান মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা চালু রাখা সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তবর্তী সরকার।

 

উল্লেখিত পরিবর্তনগুলো ছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা মেয়র ও চেয়ারম্যানের পদ অপসারণ করে জেলা প্রশাসক নিয়োগ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্যদিকে ছাত্র আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ১৮ নম্বর ধারায় জামায়েত ইসলামী বাংলাদেশকে এবং তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির কে নিষিদ্ধ করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকারের সময় জামায়াত ইসলামের সেই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। ১৫ ই আগস্ট কে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ঐদিন সরকারি সাধারণ ছুটি ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে ১৫ ই আগস্টের সাধারণ ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়।

1 thought on “শেখ হাসিনা সরকারর পতনের এক মাস: কতটুকু পরিবর্তন হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *