অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক অনুষ্ঠানে দাবি করেন,সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে দেশের সব প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। গত ১৮ ই আগস্ট রোববার দুপুরে রাজধানীর একটি হোটেলে বিদেশি বিভিন্ন মিশনের রাষ্ট্রদূত ও জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের প্রথম ব্রিফিংয়ে ড. ইউনূস বক্তব্য দেন। তিনি আরও বলেন, ‘এমন একটি সময়ে এসে দেশের দায়িত্ব নিয়েছি, যখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম বিশৃঙ্খলা। তাই নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গণমাধ্যমে সংস্কারের পর অন্তর্বর্তী সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু এবংসব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের আয়োজন করবে।’
বিদেশি কূটনীতিক ৫১ জন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার ১৬ জনসহ সব মিলিয়ে ৬৭ জন বিদেশি অতিথি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ।আর এই সব দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধান উপদেষ্টা সরকার পরিচালনায় বিদেশি কূটনীতিকদের সমর্থন চেয়েছেন।
গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের নবযাত্রায় বাংলাদেশের বন্ধু, অংশীদার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পাশে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ যে পরিস্থিতে এসে দাঁড়িয়েছে, তা থেকে উত্তরণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জোরালো সমর্থন ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার ব্রিফিং সকালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চাকরি স্থায়ীকরণের দাবিতে বিক্ষুব্ধ লোকজন পথরোধ করায় প্রায় দুই ঘণ্টা পর অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হয়।
বিশ্বে আর কোথাও ছাত্রদের এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি
ড. ইউনূস অনুষ্ঠানে দেরিতে পৌঁছানোর জন্য প্রথমেই দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেন, সংক্ষুব্ধ লোকজন তাঁর পথ আটকে দিয়েছিল। বিক্ষুব্ধরা তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত চাইছিলেন। কিন্তু তিনি তাঁদের তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি।ছাত্র-জনতার দেশ কাঁপানো ১৩ দিনের শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে জান এই শান্তিতে নোবেল বিজয়ী। তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর আর কোনো দেশে ছাত্রদের এতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি।তাদের শরীর যেভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। চোখের ভেতরে বুলেট ঢুকে গেছে। তরুণ ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে, আমরা জানি না।
স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জেগেছিল বীর ছাত্র-জনতা
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, দুই সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ দ্বিতীয় বিপ্লবের সাক্ষী হয়েছে। শেখ হাসিনার নৃশংস স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছিল লাখো বীর ছাত্র-জনতা। তাঁর (হাসিনা) দলের ছাত্রসংগঠন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে দেশে ভয়াবহ গণহত্যা করার পর হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যান।
ড. ইউনূস বলেন, ‘আমি এমন একটি সময়ে এসে দেশের দায়িত্বভার নিয়েছি, যেখানে অনেক দিক থেকেই পুরোপুরি বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ক্ষমতায় থাকার চেষ্টায় শেখ হাসিনার স্বৈরাচার সরকার দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে সম্পুর্র ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। তরুণ প্রজন্ম তাদের দীর্ঘ বছর গুলোতে ভোটাধিকারের চর্চা না করেই বেড়ে উঠেছে। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট হয়েছে।
ছাত্রদের স্বপ্নে নতুন যুগের সূচনা
ড. ইউনূস বলেন, ‘দেশ নিয়ে ছাত্রদের একটি স্বপ্ন আমাদের মুগ্ধ করেছে, যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে।’ তিনি বলেন, ছাত্ররা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা জাতিগত পরিচয়-নির্বিশেষে নিজেদের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে ও মতপ্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাক্স্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সশস্ত্র বাহিনী বেসামরিক শক্তির সহায়তায় কাজ চালিয়ে যাবে, যতক্ষণ পর্যন্ত না পরিস্থিতি নিশ্চিত হবে। সব ধর্মীয় ও জাতিগত গোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকারের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত সব হত্যা ও সহিংসতার বিচার এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ফলকার টুর্কের সঙ্গে কথা বলেছি। আমি জাতিসংঘের নেতৃত্বে একটি তথ্যানুসন্ধানী মিশন পাঠানোর জন্য জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। আমরা নৃশংসতার একটি নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত এবং পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া চাই। জাতিসংঘের তদন্তকারীদের যা যা সহায়তা প্রয়োজন, আমরা তা দেব।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন, বিচার বিভাগ, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী ও গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের জন্য দায়িত্ব পালন করব। এরপর আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করব। জাতীয় ঐকমত্য বৃদ্ধির জন্যও আমরা আন্তরিক প্রচেষ্টা চালাব।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধার করার জন্য সুশাসন এবং দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা মোকাবিলাকে অগ্রাধিকার দেবে। একই সঙ্গে শক্তিশালী ও সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সংস্কারের উদ্যোগ নেবে। তিনি বলেন, ‘আমরা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনসহ আমাদের সমস্ত আন্তর্জাতিক আইনি বাধ্যবাধকতা বজায় রাখব এবং প্রচার করব। আমাদের সরকার সব আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলো মেনে চলব। আমরা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের অবদান বজায় রাখতে এবং তা সম্প্রসারণে আগ্রহী।’
বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তা অব্যাহত রাখার কথা উল্লেখ করেন। রোহিঙ্গাদের মানবিক কার্যক্রম এবং নিরাপত্তা, মর্যাদা ও পূর্ণ অধিকারসহ তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিরন্তর প্রচেষ্টা প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রধান উপদেষ্টা।
কঠিন যাত্রায় হাত বাড়িয়ে দিন
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাংলাদেশের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য আমরা আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ অংশীদারদের বাংলাদেশের প্রতি আস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানাই। বিশ্বব্যাপী পোশাক সরবরাহের ব্যবস্থাকে ব্যাহত করার কোনো অপচেষ্টা আমরা সহ্য করব না।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘নতুন যাত্রার এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আমাদের সাহসী ছাত্র ও জনগণের জন্য আমাদের জাতির স্থায়ী পরিবর্তন প্রয়োজন। আমাদের যাত্রাটা কঠিন। তবে আন্তর্জাতিক পাশে থাকলে আমাদের এই কঠিন পথ সহজ হয়ে যাবে।