বর্তমান বিশ্বে আফ্রিকার কয়েকটি দেশে ছড়িয়ে পড়া এমপক্স নিয়ে উদ্বেগের প্রেক্ষাপটে বিশ্বজুড়ে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। একসময় মাঙ্কিপক্স নামে পরিচিত উচ্চ সংক্রামক এই রোগের প্রাথমিক প্রাদুর্ভাবে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে মারা গেছেন অন্তত সাড়ে চার শ মানুষ।
এমপক্স রোগের জন্য দায়ী মাঙ্কিপক্স ভাইরাস। এটি স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের জন্য দায়ী ভাইরাসের একই শ্রেণিভুক্ত। তবে তা গুটিবসন্তের ভাইরাসের চেয়ে অনেকটাই কম ক্ষতিকর।
মাঙ্কিপক্স ভাইরাস প্রথম পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। কিন্তু বর্তমানে মানুষ থেকে মানুষেও সংক্রমণ ঘটআফ্রিকার বৃষ্টিপ্রধান ক্রান্তীয় বনাঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকায় এ ভাইরাসের বেশি প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। বেশি আক্রান্ত দেশগুলোর একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো (ডিআর কঙ্গো)।
এমপক্সের ভয়াবহতায় প্রতিবছর কয়েক হাজার আক্রান্ত হন ও মারা যান কয়েক শ মানুষ। আর যারা মারা যায় তাদের বয়স সাধারণত ১৫ বছরের নিচের শিশু–কিশোরেরা এমপক্স বেশি আক্রান্ত হয়।
এমপক্সের দুটি প্রধান ধরন—ক্লেড ১ ও ক্লেড ২। ইতিপূর্বে ২০২২ সালে এমপক্স নিয়ে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিল স্বাস্থ্য সংস্থা। ক্লেড ২ ধরনের তুলনামূলক মৃদু সংক্রমণে জারি করা হয়েছিল এ জরুরি অবস্থা।
সর্বশেষ ২০২২ সালের জুলাইয়ে এমপক্সের মৃদু ক্লেড ২ ধরন প্রায় ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে ছিল এশিয়া ও ইউরোপের কিছু দেশও। ঝুঁকিতে থাকা গোষ্ঠীগুলোকে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনা হয় ওই সংক্রমণ।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের দিকে এমপক্সের ভাইরাসের রূপবদল হয়। এই রূপবদলে তৈরি হওয়া নতুন ধরনের নাম ক্লেড ১বি। তখন থেকেই এটি দ্রুত ছড়াচ্ছে। এটিকে একজন বিজ্ঞানী ‘এ পর্যন্ত সবচেয়ে বিপজ্জনক’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
গত মঙ্গলবার আফ্রিকা সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) বিজ্ঞানীরাও রোগটি নিয়ে জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া না হলে বর্তমান প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে বলে সতর্ক করে দেন সংস্থাটির প্রধান জ্যঁ কেসিয়া।
সিডিসি বলেছে, চলতি বছরের শুরু থেকে গত জুলাই পর্যন্ত এমপক্সে ১৪ হাজার ৫০০-এর বেশি সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এতে মারা গেছেন অন্তত ৪৫০ জন। ২০২৩ সালের একই সময়ের তুলনায় সংক্রমণের এ হার ১৬০ শতাংশ বেশি ও মৃত্যুর হার বেশি ১৯ শতাংশ।
এমপক্স সংক্রমণের ৯৬ শতাংশই শনাক্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে। তবে এটি বুরুন্ডি, কেনিয়া, রুয়ান্ডা ও উগান্ডার মতো প্রতিবেশী অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশগুলোতে এখনো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েনি এটি।
গবেষকরা বলছেন, এমপক্সের নতুন ধরন আগের চেয়ে সহজে ছড়াচ্ছে এবং শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে রোগের বেশি জটিলতা তৈরি করছে এবং প্রাণহানি ঘটাচ্ছে।
এমপক্সের লক্ষণ
জ্বর, মাথাব্যথা, ঘর্মাক্ত হওয়া, পিঠে ব্যথা ও পেশিতে ব্যথা ইত্যাদি হল প্রাথমিক লক্ষণ। জ্বরে ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। ফুসকুড়ি মুখমণ্ডল থেকে শরীরের অন্যান্য অঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। তার মধ্যে হাতের তালু ও পায়ের তলায় বেশি হয়।
ফুসকুড়িতে ভীষণ চুলকানি বা ব্যথা হতে পারে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ফুসকুড়িতে পরিবর্তন আসে ও চূড়ান্তভাবে খোসপাঁচড়ায় রূপ নেওয়ার আগে এটি কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। খোসপাঁচড়াগুলো পরে শুকিয়ে পড়ে যায়। দেখা দিতে পারে শরীরে ক্ষতচিহ্ন।
সাধারণত এ সংক্রমণ নিজে থেকে সেরে ওঠে এবং তা ১৪ থেকে ২১ দিন স্থায়ী হয়। গুরুতর সংক্রমণের ক্ষেত্রে সারা শরীর, বিশেষ করে মুখমণ্ডল, চোখ ও যৌনাঙ্গে ক্ষত দাগ দেখা দিতে পারে।
যেভাবে বিস্তার লাভ করে
এমপক্সে সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে মাঙ্কিপক্স ভাইরাস অন্যজনের শরীরে সংক্রমিত হয়ে থাকে। এমন সংস্পর্শের মধ্যে রয়েছে শারীরিক সম্পর্ক, ত্বকের স্পর্শ, কাছাকাছি থেকে কথা বলা বা শ্বাসপ্রশ্বাস।
ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করে ভঙ্গুর ত্বক, শ্বাসপ্রশ্বাস, চোখ, নাক বা মুখের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া ভাইরাস লেগে আছে এমন বস্তু, যেমন বিছানাপত্র, জামাকাপড় ও তোয়ালে স্পর্শ করেও ছড়িয়ে পড়তে পারে এমপক্স।
এছাড়া সংক্রমণের শিকার পশু, যেমন বানর, ইঁদুর ও কাঠবিড়ালি ইত্যাদির সংস্পর্শে আসলেও আক্রান্ত হতে পারে।
তবে ২০২২ সালে এমপক্স দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী মূলত অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক।
বেশি ঝুঁকিতে যারা
সংক্রমণের বেশির ভাগ ঘটনা ঘটেছে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম ব্যক্তি ও সমকামী পুরুষদের মধ্যে। বহুগামী কিংবা নতুন যৌনসঙ্গীরা সংক্রমণের সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকতে পারেন।
অবশ্য সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে যাওয়া যে কেউ সংক্রমিত হতে পারেন এ ভাইরাসে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর পরিবারের সদস্যরা।
পরামর্শ ও মতামত
আক্রান্ত হওয়া ঠেকাতে সংক্রমিত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে হবে। কমিউনিটির মধ্যে এ রোগ দেখা দিলে নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে।
এ ছাড়া সম্পূর্ণ সেরে না ওঠা পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তিকে সঙ্গনিরোধ অবস্থায় থাকতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সুস্থ হয়ে ওঠার পর আক্রান্ত ব্যক্তি শারীরিক সম্পর্ক করতে চাইলে তিন মাস পর্যন্ত কনডম ব্যবহার করতে হবে।
এমপক্স নিয়ন্ত্রণের উপায়
এমপক্সের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ ও বিস্তার রোধে সবচেয়ে প্রধান উপায় টিকা গ্রহণ। টিকার স্বল্পতা থাকায় সাধারণত তাঁরাই শুধু টিকা নিতে পারেন, যাঁরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে ও রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছেন,ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জরুরি ব্যবহারের জন্য এ টিকার সরবরাহ বৃদ্ধি করার অনুরোধ জানিয়েছে; এমনকি ওই সব দেশেও, যারা আনুষ্ঠানিকভাবে এ টিকার অনুমোদন দেয়নি।