বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং ও টর্চার সেল বন্ধে

বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং ও টর্চার সেল বন্ধে কিছু করণীয়

বাংলাদেশ
Spread the love

বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সহিংসতার ও  প্রাণহানির ইতিহাস নতুন নয়। কিন্তু অতীতে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যকার সংঘর্ষ আর গত ১৫ বছরের ছাত্র নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে চরিত্রগত দিক থেকে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন সোচ্চার-টর্চার ওয়াচডগ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে ক্যাম্পাসে ছাত্র নির্যাতনের বিভিন্ন কারণ, ধরন, স্থান, ভয়াবহতা ও নির্যাতনপরবর্তী সময়ে ভুক্তভোগীর অবর্ণনীয় কষ্টের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে র‍্যাগিং ও টর্চার সেল বন্ধে কিছু সুপারিশ ও পরামর্শ দিয়েছে।

২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের শিকার ৫০ জন ছাত্রের সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন সোচ্চারের গবেষক মেহেদি হাসান, রাহনুমা সিদ্দিকা ও ড. শিব্বির আহমদ ।

প্রায় ৮৪ শতাংশ নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে গবেষণা ফলাফলে উঠে এসেছে এইসব তথ্য। 

নির্যাতনের শিকার এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থী, হল প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, কিংবা রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ধরনের সহায়তা পাননি।

এমনকি কখনো কখনো শিক্ষকদের কাউকে কাউকে নির্যাতনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তা করার অভিযোগও পাওয়া গেছে।

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে অনীহা, রাতে হলের গেস্টরুমের মিটিংয়ে উপস্থিত না থাকা, সিনিয়র বড়ভাই নেতাদের যথাযথ ‘সম্মান প্রদর্শনে’ ব্যর্থ হওয়া, ফেসবুকে ইসলামিক পোস্ট দেওয়া বা ওয়াজ শেয়ার করা, ইসলামিক বা বিরোধী দল বা মতের পেজে লাইক দেওয়া, ফেসবুকে শেখ হাসিনা, তাঁর পিতা/পরিবার, ভারতবিরোধী বা কোনো রাজনৈতিক পোস্ট দেওয়া বা লাইক দেওয়া এবং ছাত্রশিবির বা ছাত্রদল সন্দেহে নির্যাতন করা হয়েছে।

দল বেঁধে একজনকে লাঠি, স্টাম্প, জিআই পাইপ, রড দিয়ে পিটানো, হাত-পায়ের হাড় ভেঙে দেওয়া, নখ তুলে ফেলা, সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া, মেরে ক্লান্ত হলে বিশ্রাম নিয়ে আবার নির্যাতন করা, বিশ্রামের সময় সফট ড্রিংকস খেতে দিয়ে আবার মারধর করা, নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করলে বড় ধরনের ক্ষতির হুমকি দেওয়া, মেরে মুমূর্ষু অবস্থায় পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে মিথ্যা মামলা দায়ের করাসহ নানান ধরনের শারীরিক নির্যাতন চালানো হতো। 

নির্যাতনকারীরা পুরস্কৃত হয়ে পরবর্তী সময়ে দলীয় বড় পদ পেয়েছেন, এমনকি সরকারের উচ্চ পদে চাকরি পেয়েছেন, যা নতুন নতুন নির্যাতক তৈরিতে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে।

ছাত্ররাজনীতির একটা কলুষিত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বড় হতে হতে ‘ঢাকা শহরে কোথাও থাকার জায়গা নেই দেখে হলে উঠতে বাধ্য হওয়া’ ছেলেটাও একদিন ভয়ংকর নির্যাতক হয়ে উঠেছে।

নির্যাতনের এ সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশেই শুধু বিঘ্ন ঘটায়নি, দিয়েছে ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকদের এক আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তা।

পূর্বের এসব অমানবিক নির্যাতনের বিচার এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়হীন একটা নিরাপদ ক্যাম্পাস গড়ে তোলার জন্য ‘সোচ্চার’ ১০ দফা সুপারিশ দিয়েছে:

১. সরকারি যথাযথ কমিশন গঠন করে তদন্ত: প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘটে যাওয়া নির্যাতনের ঘটনাগুলোর সঠিক বিচারের জন্য সরকারি কমিশন গঠন করে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে বিচার নিশ্চিত করা।

২. বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব তদন্ত কমিটি ও প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি: সরকারি আইনের শাস্তির পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব তদন্ত কমিটি গঠন করে জড়িত শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি নিশ্চিত করা।

৩. ভিকটিম সাপোর্ট সেল গঠন: একটি স্থায়ী ভিকটিম সাপোর্ট সেল গঠন করা, যেখানে কোনো শিক্ষার্থী শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হলে অভিযোগ করতে পারবে।

৪. প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তাবলয়: প্রথম বর্ষের ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে এবং নির্যাতনের প্রধান লক্ষ্য হয়। তাদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের জন্য আলাদা হল নির্মাণ করা, যেখানে শুধু প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা থাকবে এবং দ্বিতীয় বর্ষ থেকে অন্যান্য হলে স্থানান্তর করা হবে।

৫. ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির জন্য বিধিমালা: ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি পরিচালনার জন্য একটি কঠোর বিধিমালা প্রণয়ন করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য না করা যায়।

৬. ছাত্ররাজনীতির সংস্কার ও বয়সসীমা নির্ধারণ: ছাত্রসংগঠনগুলোর অভ্যন্তরে দীর্ঘমেয়াদি নেতৃত্বের লড়াই বা অন্তর্দলীয় কোন্দল কমাতে ছাত্ররাজনীতির জন্য সর্বোচ্চ বয়সসীমা নির্ধারণ করা যেতে পারে।

৭. হলগুলোকে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ঘোষণা: হলগুলোতেই সবচেয়ে বেশি ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। তাই নির্যাতন বন্ধে হলগুলোকে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ঘোষণা করা উচিত। হলে কোনো ধরনের মিছিল-মিটিং, গেস্টরুম মিটিং বা রুম দখল নিষিদ্ধ করা হলে নির্যাতন অনেকাংশে অবসান ঘটবে।

৮. ‘ইনক্লুসিভ ক্যাম্পাস’–সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ: র‍্যাগিং ও নির্যাতন বন্ধে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের ‘ইনক্লুসিভ ক্যাম্পা’–সম্পর্কিত প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। প্রতিটি বিভাগে অরিয়েন্টেশন প্রোগ্রামের আওতায় বা ক্যাম্পাসে স্থায়ী প্রশিক্ষণ সেন্টার গড়ে তোলার মাধ্যমে এ প্রশিক্ষণ বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।

৯. আবাসনসংকটের সমাধান: নতুন হল ও ভবন নির্মাণ করে বা উচ্চ ভবন নির্মাণের মাধ্যমে আবাসনসংকট সমাধান করা গেলে ‘হলে একটি সিট পাওয়ার জন্য রাজনীতি করে নির্যাতক হয়ে ওঠা’ সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে।

১০. ক্যাম্পাসে নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস পালন: বুয়েট ক্যাম্পাসে সরকারি ছাত্র সংগঠন দ্বারা নির্যাতনে নিহত শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের মৃত্য দিবসকে প্রতিবছর ৭ অক্টোবর সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘ক্যাম্পাস নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালন করা।

এ দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে ক্যাম্পাস নির্যাতনের ভয়াবহতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সচেতন করা হলে নির্যাতক হয়ে ওঠার প্রবণতা কমে আসবে এবং নির্যাতনের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-শিক্ষকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের স্পৃহা বাড়ানোর মাধ্যমে নির্যাতন প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো শুধু শিক্ষার জায়গা নয়, শিক্ষার্থীদের জন্য সৃজনশীল, গণতান্ত্রিক ও মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার জায়গা। নির্যাতন বন্ধ করার মাধ্যমে নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করতে পারলে শিক্ষার্থীরা ব্যক্তিগত ও শিক্ষাজীবনে আরও বেশি সফলতা অর্জন করতে পারবে।

আরও পড়ুন স্বৈরাচারের দোসরেরা এখনো দেশে–বিদেশে সক্রিয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *