লিবিয়ার সাবেক নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি নিজ দেশের অনেক জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন ভালোবাসার শাসক। কিন্তু পশ্চিমাদের চোখে একনায়ক ছিলেন । গাদ্দাফির শাসন একটানা ৪২ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তার মসনদ হারিয়ে যায়। ২০১১ সালে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সমর্থনে তার বিরোধী একটি সশ্ত্র গোষ্ঠীর হাতে আটক হন তিনি। ২০ অক্টোবর প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে।
সেই সময় লিবিয়ার বাদশাহ ছিলেন সাইয়্যিদ মুহাম্মদ ইদ্রিস বিন মুহাম্মদ আল মাহদি। গাদ্দাফির নেতৃত্বে সামরিক দলের অভ্যুত্থানে ইদ্রিসের পতন হয়।
গাদ্দাফির ৪২ বছরের শাসনামলে তাঁকে ঘিরে রয়েছে সমালোচনা, ভালোবাসা, আক্ষেপ, ঘৃণা। কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়, কেমন ছিল তাঁর শাসনব্যবস্থা, গাদ্দাফির পতন ঘটিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব কী চেয়েছিল, লিবিয়া কী পেল—এমন অনেক প্রশ্ন রয়েছে আজও। কিছু প্রশ্নের উত্তর মিলেছে, কিছু মেলেনি। এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে ফিরে যাওয়া যাক গাদ্দাফি যুগে।
গাদ্দাফির শাসনে বসা
গাদ্দাফি ছিলেন সুদর্শন ও ক্যারিশম্যাটিক তরুণ এক সেনা কর্মকর্তা। মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের ভক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৫৬ সাল থেকে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নেন। ১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর একটি দলকে সঙ্গে নিয়ে অভ্যুত্থান ঘটান। ওই সময় বাদশাহ ইদ্রিস তুরস্কে ছিলেন।
রাষ্ট্রক্ষমতা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন বাদশাহর ভাইপো যুবরাজ সাইদ হাসান অর রিদা আল মাহদি। এই সুযোগই কাজে লাগান গাদ্দাফি। রিদা আল মাহদিকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতা দখল করেন গাদ্দাফি। এভাবে তাঁর নেতৃত্বে লিবিয়া রাজতন্ত্রমুক্ত হয়। নাসেরের ভক্ত গাদ্দাফি অভ্যুত্থানের পর নিজেকে ক্যাপ্টেন থেকে কর্নেল পদে উন্নীত করেন।
কেমন ছিল গাদ্দাফির শাসন
গাদ্দাফির বিরুদ্ধে দমন-পীড়নসহ স্বৈরশাসক হিসেবে অভিযোগের পাল্লা অনেক ভারী ছিল। কিন্তু এ কথাও মানতে হবে, তাঁর শাসন আমলে লিবিয়ায় স্থিতিশীলতা অনেক বেশি ছিল। আফ্রিকাসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের অভিবাসী শ্রমিকদের কাছে লোভনীয় কর্মক্ষেত্র লিবিয়া ছিল । দেশটিতে গিয়ে তাঁরা বিপুল অর্থ আয় করেছেন। জীবনমানের উন্নয়ন করেছেন। অনেকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে এসেছেন।
তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় দেশকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করার কাজ করেছিলেন। দেশকে উন্নয়নের শিখরে নিয়ে গেলেও গাদ্দাফি ছিলেন একনায়ক। ৪২ বছরের শাসনে দিন দিন হয়ে উঠেছিলেন স্বৈরশাসক। ‘জনগণ লিবিয়া পরিচালনা করে,’ এমন স্লোগান দিলেও গাদ্দাফির সময়ে জনগণের কথা বলার স্বাধীনতা ছিল না। বিরোধী মতকে দমনপীড়ন করতেন তিনি। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে কয়েক দশকের শাসনামলে শত শত নারীর ওপর যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগ আছে, গাদ্দাফি অনেক বিচারকাজ করেছেন প্রকাশ্যে ও গোপনে। হত্যা করেছেন অনেক মানুষ। ১৯৮৮ সালে স্কটল্যান্ডের লকারবিতে প্যানঅ্যাম এয়ারলাইনসের একটি জাম্বো জেট বিমানে বোমা হামলায় ২৭০ জন নিহতের ঘটনায় গাদ্দাফির সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায়। লিবীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তা এ ঘটনার পরিকল্পনা করার জন্য অভিযুক্ত হন । ফলে লিবিয়াকে জাতিসংঘের বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয় । গাদ্দাফির শাসনের চার দশকে লিবিয়াবাসী কি সুখী ছিল? এর উত্তরে আসে না
পশ্চিমাদের সঙ্গে বিরোধ
পশ্চিমা বিশ্বের চক্ষুশূল শুরু থেকেই ছিলেন গাদ্দাফি। এছাড়া আউজো উপত্যকা নিয়ে প্রতিবেশী দেশ চাদের সঙ্গে সত্তর দশকে যুদ্ধে জড়ায় লিবিয়া। গাদ্দাফি সব সময়ই ফিলিস্তিনের পক্ষে ছিলেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকে সমর্থন দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর রোষের শিকার হন তিনি।
তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান গাদ্দাফিকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের পাগলা কুকুর’ বলতেন। ১৯৮২ সালের মার্চে লিবিয়ার তেল আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। লিবিয়ার তেলশিল্পে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ২০০৪ সালে জর্জ ডব্লিউ বুশের সময় সম্পর্কের কিছুটা উন্নতি হয়। এ সময়ে লিবিয়ার ওপর থেকে বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র।
২০০৯ সালে গাদ্দাফি আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। আফ্রিকার দেশের স্বার্থ নিয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে গাদ্দাফির ঝাঁজালো বক্তব্য, নীতিমালার অনুলিপি ছিঁড়ে ফেলা পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কে আবারও অবনতি ঘটায়। এসবেরই প্রভাব পড়তে থাকে গাদ্দাফির নিজের সাম্রাজ্যে।
গাদ্দাফিকে হত্যা
২০১০ সালের শুরুর দিকে বিশ্ব আন্দোলিত হয় আরব বসন্তের ঢেউয়ে। পরের বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিউনিসিয়া, মিসরের প্রতিবেশী দেশগুলোতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলে। তিউনিসিয়ায় জাইন আল-আবিদিন বেন আলী ও মিসরে হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হন। এ সময়েই বেনগাজি শহরে ছড়িয়ে পড়ে গাদ্দাফিবিরোধী বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমনে গাদ্দাফি বেছে নেন সহিংস উপায়। গোলাবারুদ, যুদ্ধবিমান দিয়ে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা করেন। গাদ্দাফি সরকারের অনেক মন্ত্রী এই পদক্ষেপের প্রতিবাদ করেন।
বিক্ষোভ যত জোরালো হতে থাকে, পদত্যাগ করার জন্য গাদ্দাফির ওপর পশ্চিমাদের চাপ তত বাড়তে থাকে। গাদ্দাফি ও তাঁর বাহিনীও প্রতিরোধ শুরু করে। গৃহযুদ্ধ বাধার পরপরই জাতিসংঘ গাদ্দাফিবিরোধী ন্যাশনাল ট্রানজিশনাল কাউন্সিলকে (এনটিসি) সব কিছুতে আশ্বাস দেওয়া শুরু করে। আমেরিকা ও ইউরোপের অনেক দেশই মদদ জোগায়।
এভাবে এনটিসিই হয়ে ওঠে লিবিয়ার অঘোষিত সরকার। ২০১১ সালের আগস্টে বিদ্রোহী বাহিনী ত্রিপোলিতে ঢুকে পড়ে। শহরের বেশির ভাগ এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় তারা। ২৩ আগস্ট তারা ত্রিপোলিতে গাদ্দাফির সদর দপ্তর আল-আজিজিয়া কম্পাউন্ড দখল করে। শুরু হয় গাদ্দাফির খোঁজ। গাদ্দাফি বাহিনীও প্রতিরোধ চালাতে থাকে।
গাদ্দাফির অনুগত বাহিনী সিয়ার্ত শহরে শেষ প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গাদ্দাফিকে এই শহরেই নির্মমভাবে হত্যা করা হয় । গাদ্দাফিকে হত্যার বর্ণনায় , ২০ অক্টোবর স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে আটটার দিকে গাদ্দাফির গাড়িবহরের ওপর ফ্রান্সের কয়েকটি বিমান শহর থেকে তিন-চার কিলোমিটার পশ্চিমে হামলা চালায়।
ওই সময় বিদ্রোহী সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের বিমান হামলায় গাড়িবহরের অন্তত ১৫টি সশস্ত্র পিকআপ ট্রাক বিধ্বস্ত হয়। গাদ্দাফিসহ কয়েকজন বড় একটি পাইপের ভেতরে আশ্রয় নেন। বিদ্রোহীরা কামানের গোলা ছোড়ে। পাইপের ভেতর থেকে গাদ্দাফি বের হয়ে আসার পর গুলি ছোড়া শুরু হয়।
আল–জাজিরা সে সময় এক ভিডিওতে দেখায়, রক্তাক্ত গাদ্দাফিকে বিদ্রোহীরা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। পরে এনটিসির প্রধান মাহমুদ জিবরিল সাংবাদিকদের বলেন, বিদ্রোহী ও গাদ্দাফি বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে গাদ্দাফি নিহত হন। আল-জাজিরার আরেকটি ভিডিওতে কর্নেল গাদ্দাফির মরদেহ মাটিতে টেনে নিতে দেখা যায়। এমনও বলা হয়, একসময়ের লৌহমানব গাদ্দাফির মরদেহ সেখানকার একটি বিপণিবিতানের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়।
কেমন ছিল গাদ্দাফিবিহীন লিবিয়া
পশ্চিমাদের চাওয়ায় গাদ্দাফির পতন তো হলো। এক দশকেও লিবিয়ায় কাঙ্ক্ষিত শান্তি ও গণতন্ত্র ফেরেনি। আরও বেড়ে যায় নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিতিশীলতা। অনেকটাই বেহাল লিবিয়ার সমৃদ্ধ অর্থনীতি ।
গাদ্দাফি-পরবর্তী এক দশকে ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়ার লড়াইয়ে নেমেছে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী। ধ্বংস করেছে অবকাঠামো। এই অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে জ্বালানি তেলসমৃদ্ধ লিবিয়ার অর্থনীতি ধীরে ধীরে পতনের দিকে গেছে। পশ্চিমাদের মোহভঙ্গের পর লিবিয়ায় শান্তি ফেরাতে জাতিসংঘ উদ্যোগ নেয়। ২০২০ সালের অক্টোবরে সফলতা মেলে। দেশটিতে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অস্ত্রবিরতির মধ্য দিয়ে সংঘাত থামে, শুরু হয় শান্তি আলোচনা।
এক দশক পরেও লিবিয়ার অনেকেই গাদ্দাফি ও তাঁর শাসনামলের স্মৃতি মনে রেখেছেন। তাঁর একটি বিশাল প্রতিকৃতি বনি ওয়ালিদ শহরের প্রবেশমুখে রয়েছে। ওয়ারফারা সম্প্রদায়ের মানুষ গাদ্দাফি ও তাঁর পরিবারকে মনে রেখেছেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত এএফপির এক খবরে সেখানকার বাসিন্দা মোহাম্মদ দাইরিকে বলতে শোনা যায়, ‘গাদ্দাফি আমাদের হৃদয়ে রয়েছেন। আমরা সব সময় তাঁর দেখানো পথেই চলব।’
তথ্যসূত্র: বিবিসি, বিবিসি বাংলা, আল–জাজিরা, রয়টার্স, এএফপি, ডয়চে ভেলে।
আরও পড়ুন ডোনাল্ড ট্রাম্প: আবাসন ব্যবসা থেকে প্রেসিডেন্ট