আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রক্রিয়া অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ জটিল ও আলাদা। এই প্রক্রিয়ায় সরাসরি জনসাধারণের ভোট দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় না, বরং এক ধরনের দ্বিস্তরীয় ব্যবস্থা থাকে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আগামী ৫ নভেম্বর (নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবার) ভোট দেবেন দেশটির নাগরিকেরা।আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন যেভাবে, কীভাবে,কোন প্রক্রিয়ায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তা নিয়ে কিছু প্রশ্নের উত্তর থাকছে এই লেখায়।
কারা প্রার্থী হতে পারেন
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে সংবিধান অনুযায়ী তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রার্থীকে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে, বয়স হতে হবে অন্তত ৩৫ বছর এবং ১৪ বছর যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে হবে। তবে মার্কিন সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য শেষ শর্তটির ব্যতিক্রম রয়েছে।
প্রার্থীদের যোগ্যতা
ইলিনয় স্টেটের ডেপল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ওয়েন স্টেগার ডয়চে ভেলেকে বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো নাগরিক প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারেন। এমনকি অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া ব্যক্তিরও প্রার্থী হতে বাধা নেই৷
স্টেগার জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে প্রকৃতপক্ষে আলাদা বিধান রয়েছে। যাতে রাজনৈতিক বন্দীরা প্রার্থী হওয়া থেকে বঞ্চিত না হন।
যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে রাজনৈতিক পদে থাকা ব্যক্তি দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যুক্ত হলে বা শত্রুদের সহায়তা করলে তিনি প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হতে পারবেন না। কিন্তু আসন্ন নির্বাচনে এই ধারার প্রভাবের সম্ভাবনা তেমন দেখছেন না স্টেগার।
নির্বাচনী প্রচারণা
জাতীয় কনভেনশনের পর শুরু হয় দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারণা। প্রেসিডেন্ট প্রার্থীরা বিভিন্ন রাজ্যে জনসভা, বিতর্ক এবং প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে জনগণের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করেন। নির্বাচনের আগের কয়েক মাসকে নির্বাচন প্রচারণার মূল সময় হিসেবে ধরা হয়, যেখানে তারা তাদের প্রতিশ্রুতিগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।
প্রাইমারি ও ককাস কী?
নির্বাচনে লড়াইয়ের ময়দান উন্মুক্ত থাকলেও প্রাইমারি ও ককাসের মাধ্যমে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। এই দুই পদ্ধতির মাধ্যমে দলগুলো তাদের প্রার্থী বাছাই করে। নির্বাচনী বছরের বসন্তের শুরুর দিকে অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। স্বাধীনভাবে কেউ প্রার্থী না হলে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের অধীনে তাঁকে নিজ অঙ্গরাজ্যে নিবন্ধন করতে হয়।
নির্বাচনে অঙ্গরাজ্য ও দলভেদে প্রাইমারি ও ককাসের পার্থক্য থাকলেও মূল লক্ষ্য কিন্তু একই। অন্যদিকে অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ/বাধ্যতামূলক নন এমন ডেলিগেটরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। ডেমোক্র্যাট কনভেনশনে অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ ডেলিগেটরা দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই শুধু ভোট দিতে পারেন৷
চলতি বছরের জুলাইতে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে সমর্থন দেন। সে সময় যেসব ডেমোক্র্যাট ডেলিগেট আগে বাইডেনকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরা ন্যাশনাল কনভেনশনের প্রার্থীদের যে কাউকে বেছে নেওয়ার সুযোগ পান। কেননা প্রাইমারি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে প্রার্থীকে তাঁরা বেছে নিয়েছিলেন, তিনি আর নির্বাচনে লড়ছেন না। এ ক্ষেত্রে বেশির ভাগই হ্যারিসের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, যে কারণে তিনিই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে লড়ছেন।
জাতীয় কনভেনশনের ভূমিকা
কনভেনশনে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্য থেকে আসা ডেলিগেটরা (প্রতিনিধি) প্রেসিডেন্ট প্রার্থী বাছাইয়ে ভোট দেন। একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন পেতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে হয়।
ডেলিগেটদের মধ্যেও দুটি ভাগ রয়েছে। ডেমোক্র্যাটদের ক্ষেত্রে বলা হয় প্লেজড বা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আনপ্লেজড বা অপ্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রিপাবলিকানদের ক্ষেত্রে বাউন্ড বা বাধ্যতামূলক এবং আনবাউন্ড বা বাধ্যতামূলক নন। প্রতিশ্রুতিবদ্ধ/বাধ্যতামূলক ডেলিগেটরা অঙ্গরাজ্য পর্যায়ে প্রার্থীদেরই শুধু ভোট দিতে পারেন প্রাইমারিতে জিতে আসা ।
সাধারণ নির্বাচন
নির্দিষ্ট দিনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আমেরিকান নাগরিকরা তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর পক্ষে ভোট দেন। তবে এখানে ভোটারদের সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় না। ভোটারদের ভোটের ভিত্তিতে প্রতিটি রাজ্যে নির্দিষ্টসংখ্যক ইলেকটর তাদের ভোট প্রদান করে। জনপ্রিয় ভোটে যে প্রার্থী একটি রাজ্যে জয়ী হন, তিনি সেই রাজ্যের সব ইলেকটোরাল ভোট পান (কেবল মেইন ও নেব্রাস্কা রাজ্য ব্যতিক্রম, যেখানে ইলেকটোরাল ভোট বিভাজিত হতে পারে)।
নির্বাচনে কী ঘটে
জাতীয় কনভেনশনের পরই নির্বাচনের উত্তাপ শুরু হয়। নির্বাচনের দিনে দেশজুড়ে কয়েক হাজার শহরে ভোট গ্রহণ চলে। নিবন্ধিত যেকোনো মার্কিন নাগরিক এই নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন।
ইলেকটোরাল কলেজ
সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট নয়, বরং মার্কিন প্রেসিডেন্ট কে হবেন, তা নির্ধারণ করে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’। ইলেকটোরাল কলেজ নামের ব্যবস্থায় ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত হন। তারাই শেষমেশ নির্ধারণ করবেন, যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন।
ইলেকটোরাল কলেজে ৫০টি অঙ্গরাজ্যের নির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিনিধি থাকবেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের উভয় কক্ষ মিলিয়ে রাজ্যটির যত প্রতিনিধি, সেটাই হলো তার ইলেকটরদের সংখ্যা।
হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসে (কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ) একটি রাজ্যের প্রতিনিধি সংখ্যা নির্ভর করে রাজ্যটির জনসংখ্যার ওপর। অপর দিকে সিনেটে প্রতি রাজ্যের দুটি করে আসন থাকে। সব মিলিয়ে ৫০টি রাজ্যের ৪৩৫ জন রিপ্রেজেন্টেটেটিভ ও সেই সঙ্গে ১০০ জন সিনেটর। এ ছাড়া ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার তিনজন ইলেকটর। সব মিলিয়ে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। জনসংখ্যার দিক থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় সবচেয়ে বেশি ৫৪টি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে। অপর দিকে ভারমন্টের সর্বসাকল্য তিনটি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে নির্বাচনে জিততে হলে কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠ বা অন্তত ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে হবে।
মেইন আর নেব্রাস্কা ছাড়া বাকি অঙ্গরাজ্যগুলোতে ‘উইনার টেকস অল’ ভিত্তিতে ইলেকটোরাল ভোট নির্ধারিত হয়। অর্থাৎ কোনো প্রেসিডেন্ট প্রার্থী যে রাজ্যে এগিয়ে থাকবেন, তিনি সেই রাজ্যের সব কজন ইলেকটরের সমর্থন পাবেন।
অফিস গ্রহণ
নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী জানুয়ারির ২০ তারিখে শপথ গ্রহণ করেন এবং অফিসে আসীন হন। আমেরিকায় এই দিনটিকে “ইনাগুরেশন ডে” বলা হয়। এভাবেই সম্পন্ন হয় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এই প্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক হলেও ইলেকটোরাল কলেজ ব্যবস্থার কারণে কখনো কখনো জনপ্রিয় ভোটে বিজয়ী প্রার্থী ইলেকটোরাল ভোটে পরাজিত হন, যা বিতর্কের সৃষ্টি করে। তবুও এই প্রক্রিয়া আমেরিকায় দীর্ঘদিন ধরে পালিত হচ্ছে।
আরও পড়ুন জার্মানির বার্লিন দেয়াল ভেঙে একত্রিত হয়েছিল ৪৫ বছর পর
1 thought on “আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন যেভাবে”